৮ জুলাই ২০২০, বুধবার, ১:১১

বড় দুর্নীতির ছক

গরিবের টাকা মেরে খাওয়ার জন্য এমন আয়োজন হতে পারে সেটা তাঁদের কল্পনায়ও ছিল না—এ কথাই বলছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। দেশের ৫০ লাখ প্রান্তিক মানুষকে নগদ সহায়তার টাকা দিতে গিয়ে তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন মহাদুর্নীতির এক ‘ছক’। সহায়তা পাওয়ার জন্য যে তালিকা মাঠ পর্যায় থেকে তাঁদের হাতে এসেছে, সেখানে প্রায় ২৮ লাখ মানুষের তথ্যে গরমিল রয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের পাঠানো ওই তালিকায় ঢুকে পড়েছে সরকারি কর্মচারী, সঞ্চয়পত্রের মালিক, পেনশনভোগীদের মতো লোক। সেটা যে নিছক ভুল নয়, বরং ইচ্ছাকৃত, তা-ও স্পষ্ট। এভাবে ৬৯৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন জনপ্রতিনিধিরা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক গোপন প্রতিবেদনে এমন দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। কালের কণ্ঠ’র হাতে এর একটি কপি এসেছে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এ সময় জরুরি সেবা ছাড়া অন্য সব কিছুই বন্ধ ছিল। ৬৬ দিন পর ছুটি প্রত্যাহার করা হলেও এখনো ‘সীমিত’ পরিসরে কাজকর্ম চলছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। কাজ হারিয়েছে প্রায় দুই কোটি প্রান্তিক মানুষ।

সাধারণ ছুটির মধ্যেই গত ২৫ মে উদ্যাপিত হয় ঈদুল ফিতর। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সে সময় ঈদের আগে দেশের ৫০ লাখ প্রান্তিক মানুষের জন্য আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা ঘোষণা করা হয়। এ জন্য এক হাজার ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়।

তড়িঘড়ি করে ১৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৫৬ জনকে টাকা পাঠানোর পর কর্মসূচি স্থগিত রাখা হয়। বাকি থাকা ও সংশোধিত তালিকার আরো আট লাখের বেশি মানুষকে আসন্ন ঈদুল আজহার আগে আরেক দফায় টাকা পাঠানো হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে যাদের টাকা পাঠানো হয়েছে সেই ১৬ লাখের বেশি মানুষের তথ্য ঠিক আছে কি না সে ব্যাপারে কিছু বলেননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অবশ্য এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে এই নগদ সহায়তা কর্মসূচিতে দুর্নীতির খবর এসেছে।

এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা সত্যি শঙ্কার বিষয়। মনে হচ্ছে, অনেক ভুল আছে। তবে ভালো বিষয় হলো, টাকাটা যায়নি। এটাকে ধরে রাখতে হবে। ভুল জায়গায় টাকাটা না গেলেই হলো। আর দ্বিতীয় কাজ হবে, ভুল শুধরে টাকাটা দিয়ে দেওয়া। আমার বিশ্বাস, অর্থ মন্ত্রণালয় সঠিক মানুষের হাতে টাকা তুলে দেবে। মনে রাখতে হবে, এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ। আমলাতান্ত্রিক বা অন্য কোনো জটিলতায় যেন উদ্যোগটা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।’ নিজের নির্বাচনী এলাকায় এ সহায়তা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘আমার নিজের নির্বাচনী এলাকার মানুষকে জিজ্ঞেস করি, কেমন চলছে? কেউ বলেন, টাকা পেয়েছি। আবার কেউ বলেন, ভুল আছে। ঠিক করে দেবে ইত্যাদি।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবার মাধ্যমে নগদ সাহায্য দেওয়ার প্রক্রিয়াটি কয়েক ধাপে সম্পন্ন হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তালিকায় নানা গরমিল রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এসব তথ্যের সঠিকতা যাচাই করতে বিভিন্ন তথ্যভাণ্ডারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয়ে তদন্ত করেছে।

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব তথ্য মাঠ পর্যায় থেকে এসেছে। জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা পর্যায় থেকে তথ্য আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। আমরা কোনো তালিকা করিনি। মাঠ পর্যায় থেকে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে, তা আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, মাঠ পর্যায় থেকে অনেক সময় ভুল তথ্য দেওয়া হয়। এগুলো যাচাই-বাছাই করেই টাকা ছাড় করা হবে। কোনোভাবেই ভুল মানুষের কাছে অর্থ যাবে না।

সরকারি কর্মচারী, সঞ্চয়পত্রের মালিকের নাম তালিকায় : অর্থ মন্ত্রণালয় তদন্ত করে দেখেছে, তালিকায় দুই হাজার ৮৫৫ জন সরকারি কর্মচারীর নাম রয়েছে। পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রের মালিকও নিজেকে দুস্থ পরিচয় দিয়ে সরকারের নগদ সহায়তা পেতে চাচ্ছেন। আর এমন লোকের সংখ্যা ৫৫৭। ছয় হাজার ৭৮৬ জন সরকারি পেনশনভোগীর নাম এ তালিকায় রয়েছে। দুই লাখ ৯৫ হাজার ৯১৯ জনের ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির নাম ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার লেখা হয়েছে। অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তির নামও এই তালিকায় ঢোকানো হয়েছে, যার সংখ্যা এক লাখ সাত হাজার ৩৮৬। পেশা হিসেবে বেদে, গৃহিণী, হিজড়া, পথশিশু, প্রতিবন্ধী, ইমাম, চা শ্রমিক, চা দোকানদার, ভিক্ষুক, ভবঘুরে, বেকার উল্লেখ করে টাকা মেরে খাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তালিকায় এমন মানুষের সংখ্যাও বেশ বড়, ৭৯ হাজার ৬২১। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের তথ্যে গরমিল ধরা পড়েছে ৭৬ জনের ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে এই চার লাখ ৯৩ হাজার ২০০ জনের তালিকা বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১২৩ কোটি ৩০ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা।

তালিকা অসংগতিপূর্ণ তথ্যে ভরা : অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গরিব মানুষের যে তালিকা করা হয়েছে, সেখানে অসংগতিপূর্ণ তথ্যই বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তালিকায় যেসব মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে সেগুলো নিবন্ধন করা নয়। জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে কোনো নিবন্ধন নেই—এমন আট লাখ ২৯ হাজার ৯৪৮ জনের মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। প্রান্তিক মানুষের টাকা মেরে দিতে আরো অভিনব পন্থাও দেখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাত লাখ ৯৮ হাজার ৬৭৭ জনের জন্য যে মোবাইল ফোন নম্বর তালিকায় দেওয়া হয়েছে, তাতে জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডের নম্বর ও জন্ম তারিখ নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে রক্ষিত তথ্যের সঙ্গে মেলে না। ছয় লাখ ৩৮ হাজার ৫২৬ জনের ক্ষেত্রে যে মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে তার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে নিবন্ধনকৃত মোবাইল ফোন নম্বরের কোনো মিল নেই। তালিকায় পেশা হিসেবে গৃহিণী, বস্তিবাসী, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা উল্লেখ করা হয়েছে; যদিও এগুলো কোনো পেশা নয়। ১৯ হাজার ১৮২ জনের ক্ষেত্রে এ তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। তালিকায় ভুল ফরম্যাটেও কিছু নাম বা মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মোবাইল ফোন নম্বরে ১১ ডিজিটের কম বা বেশি দেওয়া হয়েছে অথবা সঠিক ফরম্যাটে দেওয়া হয়নি—তালিকায় এমন ১৯৫ জন পেয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে এই ২২ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৮ জনের তথ্যে গরমিল পাওয়া গেছে। মোট জড়িত অর্থের পরিমাণ ৫৭১ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। তালিকাটি আবার নতুন করে পাঠাতে বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত দুই লাখ ১৭ হাজার ৭৩১ জনের সংশোধিত তালিকা পাওয়া গেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কোরবানির ঈদের আগেই আরেক দফায় বাকি থাকা এবং প্রাপ্ত সংশোধিত তালিকার মোট আট লাখ ৭৯ হাজার ৩৮৫ জনকে সহায়তার অর্থ পাঠানো হবে। এ ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, উপকারভোগীর জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্ট কার্ডের বিপরীতে সব মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া যাবে না। একটিমাত্র নম্বর দিতে হবে। কোনো মোবাইল ফোন নম্বর না থাকলে উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন নম্বরের ১১টি ডিজিট যাতে লেখা হয়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নগদ সহায়তার অর্থ নিয়ে এমন দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার কোনো তালিকা করতে দিলে মেম্বার-চেয়ারম্যানরা সেখান থেকে কিছু টাকা বাগিয়ে নিতে নিজেদের নম্বর দিয়ে দেয়—এটা আগেও করত, এখনো করে। সরকারও চায় তাদের কাছে কিছু আসুক। এটা পলিটিক্যাল ইকোনমি। তাই এটা নির্ভরযোগ্য কোনো সোর্স না।’ তিনি আরো বলেন, ‘উচিত ছিল সেলফ আইডেন্টিফিকেশন (নিজের পরিচয় নিজে নিশ্চিত করা)। সরকারের একটা নম্বরে সবাই মেসেজ দেবে, নিজেরাই জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দেবে। সরকার সেটা মিলিয়ে দেখবে। ভুল তথ্য দিলে ১০ হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যেত।’

https://www.kalerkantho.com/online/national/2020/07/08/932249