খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত চামড়া খাত। রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংক থেকে চামড়া খাতে বিতরণ করা পুরনো ঋণের প্রায় ৯০ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। এ খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা।
যার বেশির ভাগই দীর্ঘদিনের পুরনো। বাকি ৪২৮ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত রয়েছে। এগুলো চার ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গত কয়েক বছরে বিতরণ করেছে। এর মধ্যে একটি অংশ আদায় হয়েছে। আর কিছু ঋণ বকেয়া থাকলেও তা গ্রাহক-ব্যাংকার সম্পর্কের ভিত্তিতে সমন্বয় করে আবার নতুন ঋণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এবার কোরবানির চামড়া ক্রয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দেবে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংক- সোনালী, জনতা ও অগ্রণী। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সূত্র জানায়, নানা অব্যবস্থাপনা, অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণ, যাচাই-বাছাই না করে ঋণ অনুমোদন ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার কারণে বিতরণকৃত ঋণের একটি বড় অংশ খেলাপি হয়ে গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক গত ৭ বছরে চামড়া শিল্পে ঋণ বিতরণ করেছে প্রায় ৮৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ঋণ গেছে নিয়মিত চামড়া শিল্পে। বাকি ৮০৩ কোটি টাকা গেছে কোরবানির চামড়া ক্রয়ে। এসব ঋণ ১০ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে প্রায় ৫৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ভুলুয়া ট্যানারি, আমিন ট্যানারি, কালাম ব্রাদার্স ট্যানারি এবং মোহাম্মদিয়া লেদারের কিছু টাকা বকেয়া থাকলেও লেনদেন নিয়মিত রয়েছে। কিন্তু বাকি ৬ প্রতিষ্ঠান টাকা ফেরত দিচ্ছে না। তাদের দেয়া ঋণ পুরোটাই এখন কু-ঋণে পরিণত হয়েছে।
এর মধ্যে ভারসেজ সুজের কাছে প্রায় ৮ কোটি টাকা, গ্রেট ইস্টার্ন ট্যানারির কাছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, এক্সিলেন্ট ফুটওয়্যারের কাছে প্রায় ১১ কোটি টাকা, দেশমা সু ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা, এসএনজেট ফুটওয়্যারের কাছে প্রায় ১৬ কোটি টাকা এবং আনান ফুটওয়্যারের কাছে প্রায় ৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এসব খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিনের পুরনো।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান যুগান্তরকে বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভালো হওয়ায় তাদের এবারও নতুন করে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হবে। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বকেয়া টাকা আদায়ে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংক এ পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে এসব ঋণ দেয়া হয়েছে। পুরনো ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি। গত বছর ব্যাংকটি ঋণ দিয়েছিল ২০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যেই প্রায় ৭০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে। এবার ভালো দেখে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেবে জনতা ব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে জনতা ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আগে নেয়া বেশির ভাগ ঋণই খেলাপি হয়েছে, তাই এবার যাচাই-বাছাই করে সীমিত আকারে ঋণ দেয়া হবে।
এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক এ পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ঋণ বিতরণ করেছে ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। ব্যাংকটি ২০১৩ সালে ৮ প্রতিষ্ঠানকে ৯০ কোটি ৮৯ লাখ, ২০১৪ সালে ৪ প্রতিষ্ঠানকে ১২৭ কোটি ৫০ লাখ ও ২০১৫ সালে ৩ প্রতিষ্ঠানকে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকটি এ খাতে ৬০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল। এসব ঋণের বেশিরভাগই অনাদায়ি।
আদায় পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ২০১৭ সালে এ খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেও শেষ পর্যন্ত কোনো ঋণ দেয়নি ব্যাংকটি। তবে ২০১৮ সালে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল। ২০১৯ সালে দিয়েছিল ১৮৫ কোটি টাকা।
এবারও কোরবানির চামড়া ক্রয়ে ঋণ দিতে ১৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে ব্যাংকটি। অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই ঋণ দেয়া হবে। এতে পুরনো কিছু ঋণ নবায়ন করা হতে পারে। সে জন্য এবার ১৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংক ২০১৯ সাল পর্যন্ত চামড়া শিল্পে ঋণ বিতরণ করেছে ১ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। এছাড়া পুরনো খেলাপি আছে ১৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে হোসেন ব্রাদার্স ট্যানারির কাছে ২৭ কোটি ২০ লাখ, মাইজদী ট্যানারির কাছে ২৪ কোটি, এফকে লেদারের কাছে ৫১ কোটি ও মিজান ট্রেডার্সের কাছে ৩২ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে।
এসব ঋণ ১৯৮৫ সাল থেকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত। তবে ২০১৭ সালে কয়েকটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠানকে মন্দের ভালো বিবেচনায় নিয়ে ১৪৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সামিনা ট্যানারিকে ৫৫ কোটি, বেঙ্গল লেদার ৬৫ কোটি ও এইচএনএইচ লেদার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজকে দেয়া হয়েছে ১৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে। এসব ঋণ নিয়মিত থাকায় ২০১৮ সালে ১৫০ কোটি এবং ২০১৯ সালে ১৫৫ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। তবে পুরনো টাকা ফেরত না আসায় এবার নতুন করে ঋণ দেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক (এজিএম) কাজী মো. গোলাম মোস্তফা যুগান্তরকে বলেন, চামড়া খাতে পুরনো কোনো ঋণ ফেরত আসেনি। তাই এবার নতুন করে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত এখনও গ্রহণ করা হয়নি।
কোরবানির আগে চামড়া ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৫ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, মাত্র ২ শতাংশ এককালীন জমা দিয়ে চামড়ার ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। এ সুবিধা পেতে হলে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে আবেদন করতে হবে।
ব্যাংকগুলো নিজেরাই এ ঋণ পুনঃতফশিল করতে পারবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে না। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, ঋণগ্রহীতাদের আওতার বাইরে কোনো কারণে ঋণ শ্রেণিকৃত হয়ে থাকলে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সচল থাকলে তা পুনঃতফসিল সুবিধা দেয়া যাবে। কেস-টু-কেস ভিত্তিতে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ তলবি ও চলমান ঋণ সর্বোচ্চ ৬ বছর মেয়াদে এবং মেয়াদি ঋণ সর্বোচ্চ ৮ বছর মেয়াদে পুনঃতফসিল করা যাবে। এছাড়া কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কেনার জন্য নতুন ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ‘কম্প্রোমাইজড অ্যামাউন্ট’ গ্রহণের শর্ত শিথিল করা যাবে।
চামড়া খাতে সরকারি সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে উত্তরা, ন্যাশনালসহ কয়েকটি ব্যাংক কিছু ঋণ বিতরণ করে থাকে।