ফাইল ছবি
৬ জুলাই ২০২০, সোমবার, ৬:১৭

দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল

হয়রানিতে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা

টিউশন ফি ৫০ ভাগ মওকুফের দাবি কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের নাকচ * শিগগির আন্দোলনে নামছেন সব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অভিভাবকরা

দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। করোনাকালে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে সাধারণ ছুটি। শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষা নেয়নি কোনো প্রতিষ্ঠানই। অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতাও দিচ্ছে না। বিদ্যুৎ, পানিসহ পরিষেবা ব্যয় অনেক কমে গেছে।

এরপরও বেশির ভাগ স্কুল আগের মতোই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশনসহ অন্যান্য ফি আদায় করছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান স্কুল থেকে বইখাতা কিনতে বাধ্য করছে। কম্পিউটার, স্টেশনারিসহ বিভিন্ন খাতে ধার্য করেছে মোটা অঙ্কের অর্থ। এ অবস্থায় অন্তত ৫০ শতাংশ হারে ফি মওকুফসহ বিভিন্ন দাবি তুলেছেন অভিভাবকরা। দাবি আদায়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্কুলের সামনে মানববন্ধন ও কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। এছাড়া সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অভিভাবকরা মিলে নতুন সংগঠন গড়ে তুলেছেন। দু-একদিনের মধ্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।

এদিকে ফি মওকুফের দাবি তোলায় বিভিন্ন স্কুল অভিভাবকদের হয়রানির পথ বেছে নিয়েছে। কোনো কোনো স্কুলে অনলাইন ক্লাস শুরু করলেও অনেক শিক্ষার্থীকে লিঙ্ক দিচ্ছে না। রেজাল্ট প্রকাশ না করাসহ বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে। ইমেইল পাঠিয়ে সন্তানকে ছাড়পত্র দেয়া ও মানববন্ধন করায় আইনি ব্যবস্থা নেয়ার হুমকিও দিচ্ছে। এসব ঘটনায় অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এর আগে এ বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবক উভয়পক্ষকে মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এক নয়।

যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আগামী ক’মাস কিছুটা হলেও চলার মতো সামর্থ্য আছে তাদের অনুরোধ করব যাতে ফি কিস্তিতে নেয়া হয়। সামর্থ্য আছে এমন অভিভাবকদের ফি পরিশোধের অনুরোধ করব। এক্ষেত্রে অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষ উভয়কেই ছাড় দিতে হবে। জানা গেছে, করোনাকালের দুঃসময় বিবেচনায় নিয়ে অভিভাবকরা দাবি তোলার আগেই দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল মাস্টারমাইন্ড, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড স্কুলসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মওকুফ করেছে। হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল মওকুফ করেছে ২০ শতাংশ। অপরদিকে লিখিত আবেদন ও মানববন্ধন করার পরও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান মওকুফের কোনো ব্যবস্থা করেনি। উল্টো ফি পরিশোধে অভিভাবকদের জন্য উচ্চসুদে ঋণের ব্যবস্থা করেছে উত্তরার একটি স্কুল। এ ঘটনার প্রতিবাদে ২৩ জুন মানববন্ধন করেছেন উত্তরার দিল্লি পাবলিক স্কুলের (ডিপিএস) অভিভাবকরা। হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সামনে দু’দফা মানববন্ধন করা হয়েছে।

দিল্লি পাবলিক স্কুলের অভিভাবকরা বলেন, সীমিত আকারে অনলাইনে ক্লাস চলছে। এর খরচ তেমন একটা নেই। কেননা শিক্ষকরা বাসায় বসে ক্লাস নিচ্ছেন। আর শিক্ষার্থীরা বাসায় থেকে ক্লাস করছে। তাই তারা ৫০ শতাংশ টিউশন ফি দিতে আগ্রহী। তাও সবার ক্ষেত্রে নয়। যেসব অভিভাবকের আর্থিক সংকট চলছে কেবল তাদের মওকুফের দাবি করছেন তারা। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ অমানবিক আচরণ করছে। প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ফোরামের সভাপতি ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ইমেইলে অভিভাবকদের হুমকি দেয়া হচ্ছে যে, ফলাফল প্রকাশ করা হবে না। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের লিঙ্ক দেয়া হচ্ছে না।

ভাটারা থানা এলাকায় অবস্থিত হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল আরেক ধাপ এগিয়ে। ফি কমানোর দাবিতে মানববন্ধন করায় কঠোর ভাষায় অভিভাবকদের ইমেইল করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অভিভাবকদের আন্দোলনকে ‘দুষ্কর্ম’ আখ্যা দিয়ে ২৯ জুন স্কুল কর্তৃপক্ষের লেখা চিঠিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি কতিপয় বিবেকহীন সুবিধাবাদী অভিভাবক নামধারী ব্যক্তি অনৈতিক দৃষ্টিকটু কার্যকলাপ আরম্ভ করেছেন। স্কুলের বেতন দিতে ইচ্ছুক অভিভাবকদের বাধাগ্রস্ত করেছেন যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এতে যারা লিপ্ত, স্কুলের সিসিটিভি ফুটেজে তাদের ছবি আছে। স্কুল তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার রাখে।’ এতে আরও বলা হয়, ‘হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতি যে অভিভাবকরা অসন্তুষ্টি পোষণ করেন, তাদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ রইল হার্ডকোর মতো আরও পাঁচ শতাধিক স্কুল শহরে রয়েছে আপনার মনের মতো স্কুলটি বেছে নিন।’

এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ড. জিন্নাত আলী যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যে তিন মাসের জন্য ২০ শতাংশ ফি কমানো হয়েছে। আইনত বছরে ১০-১৫ শতাংশ ফি বাড়ানোর ক্ষমতা রাখি, যা এ বছর করা হয়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠান অভিভাবকদের ভ্যাট পরিশোধ করে। সবমিলে ৪০ শতাংশ ভর্তুকি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ফোরামের আহ্বায়ক কল্যাণ ওয়াদ্দার যুগান্তরকে বলেন, এপ্রিল থেকে করোনাকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত টিউশন ফি অর্ধেক করার দাবি করেছি আমরা। তারা বলছেন, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ২০ শতাংশ কমাবেন। অপরদিকে অন্যান্য খাতে ফি’র পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কম্পিউটার, স্টেশনারির মতো খাতে সাড়ে ৫ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট পরিশোধের ঘটনা নতুন নয়। স্কুল থেকে বেশি দরে নিুমানের বই কিনতে হয়। সুতরাং অভিভাবকদের দাবি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি।

রাজধানীর ইস্কাটনে অবস্থিত এজি চার্চ এবং ধানমণ্ডির ম্যাপল লিফ স্কুলের অভিভাবকরা একই কথা জানিয়েছেন। এই দুটি স্কুলেও ফি কমানো হয়নি। উল্টো পাওনা দিতে নানাভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে। উভয় স্কুলের অভিভাবকরা জানান, সবচেয়ে বিপাকে নবম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পর্ব শুরু হওয়ায় তারা রীতিমতো জিম্মি। টাকা না দিলে ভর্তি, ছাড়পত্র এবং রেজাল্ট কার্ড না দেয়াসহ নানা বিষয়ে হুমকি দেয়া হচ্ছে। মুজিবুর রহমান নামে এজি চার্চ স্কুলের এক অভিভাবক জানান, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এই অবস্থার কারণে অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ।

দেশের সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অভিভাবক ফোরামের আহ্বায়ক একেএম আশরাফুল হক যুগান্তরকে বলেন, করোনাকালে স্কুলের নানা ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে অনলাইন ক্লাস নেয়ায় স্কুলের ব্যয় যা হয় তাতে ৩০ শতাংশের বেশি টিউশন ফি পরিশোধ করা লাগে না। তবু আমরা ৫০ শতাংশ পরিশোধ করতে চাচ্ছি। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান মানছে না। এ কারণে আমরা মঙ্গল-বুধবার প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি-দাওয়া ও কর্মসূচি ঘোষণা করব।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/323045