ছবি: যুগান্তর
৩ জুলাই ২০২০, শুক্রবার, ১২:৫৩

কোভিড মোকাবেলায় মহাপরিকল্পনা

দুর্বল কৃষি ব্যবস্থায় বঞ্চিত কৃষক

কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের ব্যাংক হিসাবে সরাসরি ঋণ * সহজ শর্তে কৃষি ব্যবসার উন্নয়নে বিপণন ঋণ প্রদান

দুর্বল কৃষি বিপণন ব্যবস্থার কারণে পদে পদে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের কৃষকরা। তাদের নেই কোনো ‘অভিভাবক’। কৃষকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নেই কোনো সমন্বয়। মূলধন সংকট ও মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণের অভাবে কৃষকদের ইচ্ছা থাকলেও তারা বিনিয়োগ ঘরে তুলতে পারেন না। যেটুকু পারছেন তাও আবার মধ্যস্বত্বভোগীদের খপ্পরে পড়ে সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যেও বিক্রি করতে পারছেন না।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকার নিয়েছে ‘বিশেষ কর্মপরিকল্পনা-২০২০’। এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে- কৃষিকে লাভজনক করার মাধ্যমে সবার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি কোভিড-১৯ এর মতো বিভিন্ন আপৎকালীন পরিস্থিতি সুষ্ঠুভাবে মোকাবেলা করা। আর এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যেসব দুর্বলতা রয়েছে সেগুলোও তুলে ধরা হয়েছে মহাপরিকল্পনায়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দুর্বল কৃষি ব্যবস্থাপনা, কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, ফসল সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি, কৃষকের মূলধনের অপ্রতুলতা, মানসম্পন্ন কৃষি উপকরণের অভাব, উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকা, কৃষিপণ্য পরিবহন ও বাজারজাতকরণে দুর্বল অবকাঠামো, কৃষিজাত পণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে অপর্যাপ্ততা।

এছাড়া কৃষকদের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে বেশকিছু প্রস্তাব করা হয়েছে মহাপরিকল্পনায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তাদের ব্যাংক হিসাবে সরাসরি ঋণ প্রদান, সহজ শর্তে কৃষি ব্যবসার উন্নয়নে বিপণন ঋণ প্রদান, প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ, কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের স্তর কমিয়ে আনা, দেশের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে কৃষিপণ্য সরবরাহে পথে পথে পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ করা, নির্ভুল কৃষি আবহাওয়া সিস্টেম গড়ে তোলা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদলে কৃষক সমবায় সংগঠন গড়ে তোলা এবং করোনার প্রভাব মোকাবেলায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গতিশীল করা।

জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক যুগান্তরকে বলেন, করোনার কারণে সারাবিশ্বে খাদ্য সংকট হবে। এই সংকট মোকাবেলায় আমরা কার্যকর কিছু করতে চাই। দেশের মানুষের খাদ্যের জোগান দেন কৃষকরা। ফলে জনগণের স্বার্থেই এখন সময় এসেছে কৃষির দিকে, কৃষকের দিকে বিশেষ নজর দেয়ার। আমরা এখন কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ করতে চাই। যাতে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হন। আমার মন্ত্রণালয় থেকে এ জাতীয় সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তিনি জানান, কৃষকের উৎপাদিত ফসল যাতে ভোক্তাদের হাতে নির্বিঘ্নে পৌঁছে, সেজন্য তারা পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, পুলিশ পথে পথে যেন চাঁদাবাজি বন্ধ করে। এতে বিপণন ব্যবস্থা সহজতর হবে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মো. বখতিয়ার যুগান্তরকে বলেন, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি- এই তিন ধাপে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে মন্ত্রণালয়। আমি মনে করি, কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকরণ করা গেলে দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব। করোনার কারণে গার্মেন্টস খাত হুমকির মুখে। এ অবস্থায় যদি কৃষিপণ্যের দিকে নজর দেয়া যায় দেশ উপকৃত হবে।

কিভাবে এটি করা হবে এবং কোন কোন পণ্য বিদেশে রফতানি করার সুযোগ আছে- এ প্রশ্নে ড. বখতিয়ার বলেন, আমরা আম রফতানি করতে পারি। দেশে ১২ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। পাকিস্তানে হয় ৮ লাখ মেট্রিক টন। অথচ তারা মধ্যপাচ্যে এক লাখ মেট্রিক টন আম রফতানি করে দেশে অর্থ আনছে। আমরাও আমসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য রফতানি করতে পারি। এজন্য সংশ্লিষ্ট দেশের বাণিজ্য নীতিমালা আমাদের অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. কামরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কৃষি বিপণন অধিদফতর খুব দুর্বল। এখানে দরকার দক্ষ জনবল। সরকারের পরিকল্পনা আছে, কৃষি থেকে যারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছে ভবিষ্যতে তাদের নিয়োগ দেয়ার। তিনি বলেন, সরকার যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তাতে একটা বিষয়কে জোর দিতে হবে, সেটা হল কৃষক সমবায়। কৃষি বিপণন অধিদফতর ও কৃষক সমবায় অধিদফতর হলে কৃষকরা সরাসরি ভোক্তার কাছে বা মার্কেটে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবেন। কৃষক-কাস্টমার মিলে একটা সেতুবন্ধও তৈরি হবে। উন্নত দেশেও এ ব্যবস্থা আছে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই বর্তমানে ২ হাজার ১০০ কৃষক সমবায় সংগঠন রয়েছে। যেখানে কৃষকের সংখ্যা প্রায় বিশ লাখ। জাপানে একটা ফুলকপি কোন কৃষক উৎপাদন করছেন তাও পণ্যের গায়ে লেখা থাকে। কৃষক নিজেই জাপান এগ্রিকালচার আউটলেটে পণ্য বিক্রি করেন। বর্তমানে ভারতেও পল্লী জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ ভাগ কৃষক সমবায়ের উপকারভোগী। ফলে এদিকটার প্রতি নজর দেয়ার সময় এসেছে।

ওই গবেষক আরও বলেন, কৃষিঋণ বিতরণের বর্তমান নীতিমালা ও তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানের প্রয়োগে একটি সমন্বিত গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ প্রক্রিয়াকে আরও যুগোপযোগী করা যেতে পারে। অন্যদিকে সরকার গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি কৃষক পরিবারকে ঋণের আওতায় নিয়ে আসতে পারে।

এদিকে কোভিড-১৯-কে সামনে রেখে করা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে কি কি সুযোগ তৈরি হবে তাও তুলে ধরা হয় রূপরেখায়। এতে বলা হয়, পাহাড়ি এলাকা, চর এবং দক্ষিণ অঞ্চল এবং অন্যান্য অঞ্চলের অব্যবহৃত অনাবাদি কৃষি জমি আবাদের আওতায় আনতে হবে। আউশ ধানের আবাদ এলাকা বাড়াতে হবে, স্থানীয় জাতের ফসলের সঙ্গে উফশী জাতের ফসলের প্রতিস্থাপন করতে হবে। উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন বাড়াতে হবে, কৃষিজাত পণ্যে মূল্য সংযোজন ও মূল্য সংযোজিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করতে হবে। এছাড়া উত্তম কৃষি পদ্ধতিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য উচ্চমূল্যে বিক্রয় ও বিদেশে রফতানি করতে হবে। কৃষি জমিতে সেচ দক্ষতা ও যান্ত্রিকীকরণ বাড়াতে হবে, সেচ পাম্প পরিচালনায় সৌরশক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করতে হবে।

মহাপরিকল্পনায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে আরও বলা হয়, সময়মতো বোরো, আমন ও আউশসহ অন্যান্য ফসলের বপন, রোপণ ও সংগ্রহ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রতি বছর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। হাওর অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। বীজ, সার ও সেচ সরবরাহসহ প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ আরও সুলভ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা এবং মাঝারি ও বড় কৃষি ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করতে হবে। কৃষি প্রণোদনা ও কৃষি ঋণ সরাসরি কৃষকের ব্যাংক হিসাবে যাবে। সহজ শর্তে কৃষি ব্যবসার উন্নয়নে বিপণন ঋণ প্রদান করতে হবে।

কৃষি বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়ে পরিকল্পনায় বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্যে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান ও চাল সংগ্রহের কার্যক্রম বাড়াতে হবে। কৃষক বিপণন গ্রুপ বা দল গঠন এবং উৎপাদক ও বিক্রেতার সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সংযোগ স্থাপন করবে। সরকারিভাবে গৃহীত খাদ্য সংরক্ষণে প্রয়োজনে বেসরকারিভাবে গোডাউন নিতে হবে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, জেলখানা ও হাসপাতালের প্রতিদিনের সবজি সংগ্রহে সবজি উৎপাদনকারী কৃষকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। কৃষকের বাজার কার্যক্রম জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণ করতে হবে।

কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে এতে আরও বলা হয়, চাহিদাভিত্তিক কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, নির্ভুল কৃষি আবহাওয়া পূর্বাভাস সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। যাতে কৃষকরা জানতে পারেন কোন পরিস্থিতিতে তাদের করণীয় কি হবে। এতে চুক্তিবদ্ধ চাষ ও বিপণন ব্যবস্থা জোরদার করা, এগ্রো প্রোডাক্ট তৈরির জন্য প্রসেসিং সেন্টার স্থাপন করা, কৃষিপণ্যের সাপ্লাই চেইন ও ভ্যালু চেইন উন্নয়নে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার কথা বলা হয়।

এছাড়া নারী কৃষি উদ্যোক্তা উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা এবং কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণকে স্বীকৃতি দিতে হবে মর্মে পরিকল্পনায় সুপারিশ করা হয়। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়ে পরিকল্পনায় আরও বলা হয়, এর জন্য যৌক্তিক কৃষিপণ্য বিপণনে কৃষিপণ্যের মূল্য নীতি করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এভাবে ধাপে ধাপে দেশের কৃষি ব্যবস্থা একটা সক্ষম জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। যেখানে কৃষকদের দেয়া হবে সর্বোচ্চ প্রাধান্য।

কৃষি অর্থনীতি শক্তিশালী করতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত থাকলে অথবা বিক্রীত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যা আগামী ফসল বছরগুলোতেও তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে ফেলবে। কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। যা আমাদের আমদানিনির্ভর সরবরাহ লাইনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। সে কারণে এখন থেকেই কৃষি ব্যবস্থার প্রতি সংশ্লিষ্ট সবার বিশেষ নজর দিতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/322076/