বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ এর ধাক্কায় ডুবে যাওয়া মর্নিং বার্ড লঞ্চ মঙ্গলবার পানির ‍ওপর টেনে তোলা হয়। ছবি-সংগৃহীত
২ জুলাই ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১২:৪৬

সংঘর্ষের কারণেই ৪২ শতাংশ লঞ্চ দুর্ঘটনা

২৯ বছরে ৫৭০টি ঘটনায় নিহত ৩৬৫৪ * মূল কারণ চালকের অদক্ষতা ও অসতর্কতা * কঠোর সাজার বিধান না থাকায় মালিক ও চালকরা বেপরোয়া * সাজা বাড়াতে গিয়ে পিছু হটে নৌপরিবহন অধিদফতর

মেঘনা নদীতে এমভি বোগদাদিয়া-১৩ ও এমভি মানিক-৪ লঞ্চের সংঘর্ষের ঘটনায় দু’জনের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আরেকজনের দুই পা মারাত্মক জখম হয়। ওই ঘটনায় একজন মারা যান। সম্প্রতি যেসব নৌদুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছেন, সেগুলোর মধ্যে এটি একটি। ৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুরে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নৌপরিবহন অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে রং সাইডে লঞ্চ দুটি চালানোর কারণে সংঘর্ষে এ হতাহতের কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্তে দোষী হলেও চালকরা চাকরিতে বহাল আছেন। দুই লঞ্চের মালিক হতাহতদের পরিবারকে কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় সেরেছেন। সর্বশেষ বুড়িগঙ্গা নদীতে দুটি লঞ্চের সংঘর্ষে ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুধু বোগদাদিয়া-১৩ ও মানিক-৪ লঞ্চ নয়। এ ধরনের অনেক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি পিনাক-৬সহ অনেক লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছিল, সেসব কর্মকর্তার পদোন্নতিও দেয়া হয়েছে। এভাবে বারবার পার পেয়ে যাওয়ায় মালিক, চালক ও সরকারি কর্মকর্তারা অনেকটাই নির্ভার থাকেন।

নৌপরিবহন অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে সবচেয়ে বেশি লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে সংঘর্ষের কারণে। শুধু এ কারণে নৌপথে দুর্ঘটনার হার ৪২ দশমিক ৭০ শতাংশ। চালকের অদক্ষতা, অসতর্কতা, বেপরোয়া মনোভাব ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে নৌযানের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে অতিরিক্ত যাত্রী বা মাল বোঝাই, বৈরী আবহাওয়া, অগ্নিকাণ্ড ও তলদেশ ফেটে যাওয়া অন্যতম।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বছরে ৫৭০টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৬৫৪ জন মারা গেছেন। এসব ঘটনায় ৫১৬ জন আহত ও ৪৮৯ জন নিখোঁজ হন। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে যাত্রীবাহী নৌযানের সংখ্যা ২৩৬টি। ২০১৯ সালে ২৬টি নৌদুর্ঘটনায় তিনজন মারা গেছেন। ৩৩ জন আহত ও ২০ জন নিখোঁজ হন। এর আগে ২০১৫ সালে ২২টি দুর্ঘটনায় ১২০ জন মারা যান। সর্বশেষ সোমবার বুড়িগঙ্গায় মর্নিং বার্ডডুবিতে ৩৪ জন মারা গেছেন।

নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান ও ধরন অনুযায়ী শুধু সংঘর্ষে ৪২ দশমিক ৭০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত যাত্রী বা মাল বোঝাইয়ের কারণে ২৪ দশমিক ৭০ শতাংশ, বৈরী আবহাওয়ার কারণে ২৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং অন্যসব কারণে ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, সংঘর্ষের বেশির ভাগ ঘটনার সঙ্গে মানুষ জড়িত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আইনে কঠোর সাজার বিধান না থাকায় মালিক ও চালকরা বেপরোয়া আচরণ করেন। এছাড়া নৌযান দুর্ঘটনা তদন্ত, মামলা ও আদালতে সরকার পক্ষের জোরালো ভূমিকা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে দোষীরা দায়মুক্ত হোন।

অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল আইনের খসড়ায় চালক বা মালিকের গাফিলতিতে দুর্ঘটনায় জানমালের ক্ষতি হলে ১০ বছর সাজার প্রস্তাব করা হলেও সেটি থেকে সম্প্রতি সরে এসেছে নৌপরিবহন অধিদফতর। মালিক ও শ্রমিক নেতাদের চাপে ৫ বছর সাজার বিধান রেখে আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, আইনের খসড়ার ওপর মতামত নেয়া হচ্ছে। সবাই সাজা বাড়ানোর পক্ষে মত দিলে তা বাড়ানো হবে। স্টেকহোল্ডারদের মতামত ছাড়া আইন চূড়ান্ত করা যায় না। দুর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, সংঘর্ষের কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এটি চালকের অবহেলা ও অসাবধানতার কারণে হচ্ছে। একই ধরনের মত দেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে মালিক ও চালকদের অসতর্কতা ও অসাবধানতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, নৌ দুর্ঘটনার পরপরই যত আলোচনা-সমালোচনা হয়। এরপর তা নিয়ে আর কারও মাথাব্যথা থাকে না। দুর্ঘটনা তদন্ত, মামলা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের চাপ থাকে। দায়ীদের বেশির ভাগ পার পেয়ে যান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আর্থিক জরিমানা করা হয়।

জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত জাহাজের সংখ্যা ১২ হাজার ৯৫৯টি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/321743/