৩০ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ১:৩৯

উজানের ঢলে বন্যা, ৭ জেলার মানুষ পানিবন্দী

সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দফায় দফায় বন্যার আশঙ্কা

চলতি বছরে দেশে দফায় দফায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। জুনের শেষ দিকে শুরু হওয়া এ বন্যার পর আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মধ্যে কয়েক দফা বন্যা হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, পরবর্তী বন্যাগুলো উত্তরাঞ্চল ও চট্টগ্রামের দিকে বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

এ দিকে চলতি বন্যার বিস্তৃতি বাড়ছে। অব্যাহত বৃষ্টিতে প্রতিদিন বাড়ছে দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি। তার সাথে উজানের পাহাড়ি ঢলে বেড়েছে বিপদ। এতে তলিয়ে যাচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদ। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এ বন্যায় দেশের ১৮ জেলা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন আবহাওয়াবিদরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম জানান, ভারতসহ এ পুরো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে মৌসুমি বায়ু এবার শক্তিশালী ও সক্রিয় রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের উজানে ভারতীয় অংশে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে। সামনের দিনে এ বৃষ্টি আরো বাড়তে পারে। ফলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে দফায় দফায় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, এবার বর্ষার আগেই মে ও জুনের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে ভারী বৃষ্টি নিয়ে দেশে বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা মৌসুমি বায়ু ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই বৃষ্টি আগামী অক্টোবর পর্যন্ত থেমে থেমে চলবে। ফলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আরেক দফা বন্যার ধাক্কা সামলাতে হতে পারে। যার বি¯ৃÍতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি জানান, জুন থেকে অক্টোবর বানের সময়। এ সময় অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিতে বন্যা হয় না। পাহাড়ি ঢলে দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর আগে ২০১৭ সালের জুলাই-আগস্টে দুই দফা বন্যা হয়। ওই সময় আগস্টের বন্যায় দেশের ৩০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়। গেল বছর জুলাইয়ে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ২৮ জেলায় ৩০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বর্ষার শুরু থেকে এবার বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। বাকি সময়জুড়ে থেমে থেমে বৃষ্টি হতে পারে। অন্য দিকে বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে নিয়মিত ৫০ থেকে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হচ্ছে। দেশের ভেতরে ও উজানের বৃষ্টি মিলেমিশে চলতি বন্যা দেখা দিয়েছে। তাই ধারাবাহিক পূর্বাভাস বলছে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরেক দফা বন্যার কবলে পড়তে পারে দেশ। এ ছাড়া মৌসুমি বায়ুর কারণে দেশের উপকূলে দমকা হাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, তিস্তায় বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েক দিন ধরে চলা বৃষ্টিপাতের সাথে যোগ হয়েছে উজানের ঢল। ভারতের আসাম, মেঘালয়, সিকিম ও জলপাইগুড়ির ভারী বর্ষণের প্রভাবে এরই মধ্যে দেশের নদ-নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমা অতিক্রম করছে। এতে করে বেশি প্লাবিত হচ্ছে দেশের উত্তরাঞ্চল।

বিভিন্ন অঞ্চলে নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার কথা জানিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীগুলোর পানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের ফলে মেঘনা অববাহিকার সুরমা-কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী এবং দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকার সাঙ্গু, মাতামুহুরী এবং হালদা নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। একই অবস্থা হবে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা ও ধরলার।

পূর্বাভাস বলছে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের ১৮ জেলায় পর্যায়ক্রমে বন্যা বিস্তৃত হতে পারে। এতে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, দিনাজপুর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ীতে বন্যা হতে পারে। ইতোমধ্যে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও লালমনিরহাটে তিস্তার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে।

এ ছাড়া বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের অন্তত পাঁচটি নদীর পানি পাশের জেলাগুলোয় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, পদ্মা, আত্রাই ও হাওর এলাকার নদীগুলোর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে যেতে পারে। সব মিলিয়ে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১৮ জেলায় আগামী দুই সপ্তাহ বন্যার পানি থাকতে পারে।

সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, উজানের পানি ছাড়াও দুই সপ্তাহ ধরে উত্তরাঞ্চলে যে টানা বৃষ্টি হচ্ছে, তা দিনাজপুর থেকে নিচের দিকে নওগাঁর আত্রাইয়ে গিয়ে পড়ছে। এতে ওই জেলা ও বগুড়ায় বন্যা হতে পারে। বাকি এলাকার বন্যা মূলত উজানে ভারত থেকে আসা পানি থেকে সৃষ্টি হবে। তবে সব জেলায় টানা দুই সপ্তাহ ধরে বন্যা হবে, তেমনটা নয়। কোনো কোনো জেলায় এই সময়ে বন্যার পানি থাকতে পারে। এর মধ্যে পদ্মার পানির তোড় বা ¯্রােত বেশি থাকতে পারে। এতে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও মুন্সীগঞ্জে বন্যার সাথে নদীভাঙনও হতে পারে এবং কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

অন্য দিকে, উত্তরাঞ্চলের সাত জেলার কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। সুনামগঞ্জ জেলা শহরের অন্তত তিন শতাধিক বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টির পানিতে নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলা সদরসহ আটটি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এ দিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পানি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে প্রতি জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ফারাক্কা ব্যারাজের গেটগুলো খোলা থাকে। গঙ্গা অববাহিকার উজানে নিম্নচাপজনিত কারণে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। এতে ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যা দেখা দিয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/511906