২৯ জুন ২০২০, সোমবার, ১:৩৩

বিদ্যুৎ স্বাস্থ্য পরিবহন এডিপির অর্থ ব্যবহার করতে না পারার শীর্ষে

বরাদ্দ দিলেও অব্যয়িত সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা; বিদ্যুতে ১৭০০ এবং স্বাস্থ্যে ১৬০০ কোটি টাকা

উন্নয়ন প্রকল্পে টাকা বরাদ্দের জন্য লবিং ও চিঠি চালাচালি করে। কিন্তু টাকা বরাদ্দ দিলেও সক্ষমতার অভাবের কারণে সেগুলো পুরোপুরি ব্যয় করতে পারে না অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৯ হাজার ৪৩৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যবহার হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে, বিদ্যুৎ খাতে এক হাজার ৭০৪ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাতে এক হাজার ৬ শ’ কোটি টাকা, পরিবহন খাতে এক হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। গুরুত্বপূর্ণ সাতটি খাতে অব্যয়িত অর্থের পরিমাণ সাত হাজার কোটি টাকা বলে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, এগুলো হলো পুরনো সমস্যা। ব্যবস্থাপনার সমস্যার কারণেই প্রকল্পে এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দাতাদের অনুমোদন, একনেকের অনুমোদন, অর্থছাড় সবই হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প বসে আছে ঝিম মেরে।

অর্থবছর সমাপ্তির এক বছর পর বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এই পর্যালোচনা প্রতিবেদন বই আকারে প্রকাশ করেছে সম্প্রতি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ অর্থই পড়ে ছিল। এর মধ্যে বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়নসহায়তা খাতে স্থানীয় মুদ্রা ও প্রকল্প সাহায্য বাবদ ২৮৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যা আলোচ্য বছরে এডিপি বরাদ্দের শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ। প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে স্থানীয় মুদ্রার পরিমাণ ৫১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং প্রকল্প সাহায্য ৪১ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাকি ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ অর্থ ছিল সংস্থার নিজস্ব। বৃহৎ বরাদ্দ পাওয়া সাতটি খাতে অব্যয়িত অর্থের পরিমাণ হলো ৬ হাজার ৯৭৫ কোটি ৫ লাখ টাকা, যা মোট এডিপি বরাদ্দের ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

এদের মধ্যে অব্যয়িত অর্থের পরিমাণ হলো, বিদ্যুৎ খাতে এক হাজার ৭০৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতে এক হাজার ৬ শ’ কোটি টাকা, পরিবহন খাতে এক হাজার ৩৪৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, ভৌত পরিকল্পনা ও পানি সরবরাহ খাতে এক হাজার ১২৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা, শিক্ষা ও ধর্ম খাতে ৫৬৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতে ৩২৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ৩০২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এখানে ১০৬টি প্রকল্পের জন্য মোট ১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল।

ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্পে ২ শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এক বছরে তারা একটি টাকাও খরচ করতে পারেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দু’টি দেশে বাংলাদেশ চ্যান্সেরি ভবন নির্মাণ প্রকল্পে এক টাকাও খরচ করেনি। দু’হাজার ২৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ের অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ প্রকল্প চলতি বছর শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছর প্রকল্পে কোনো অর্থই খরচ হয়নি। কারণ প্রকল্পটির ওই বছর কোনো কাজই হয়নি। চার শ’ কোটি টাকা ব্যয়ের বিদ্যুতের পাঁচ লাখ স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার প্রকল্পেও কোনো টাকাই ব্যয় হয়নি। এক লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পটিকে এডিপিতে রাখা হয়। কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগার সংস্কার প্রকল্প, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের টেস্টিং ল্যাব প্রকল্প।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল রিমোট এলাকার জন্য আইসিটি নেটওয়ার্ক স্থাপন প্রকল্পের জন্য। কিন্তু এক বছরে প্রকল্পে কোনো কাজও হয়নি এবং অর্থও ব্যয় হয়নি। মুরাদপুর ২ নম্বর গেট এবং জিইসি জংশন ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ সালে শুরু করা হয়। আলোচ্য বছরে কোনো টাকাই খরচ হয়নি। ২০১২ সালে নেয়া আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সেবা সরবরাহ প্রকল্পটিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কোনো টাকাই খরচ হয়নি। বরাদ্দ ছিল নামমাত্র এক লাখ টাকা। একই দশা মিরসরাই অর্থনৈতিক জোনের জন্য ফেনী নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের। ঢাকা শহরে খুচরা কাঁচাবাজার স্থাপন প্রকল্পেও কোনো অর্থ ব্যয় হয়নি এক বছরে। পল্লী জনপদ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত সাড়ে ২৫ কোটি টাকার পুরো অর্থই অব্যয়িত থাকে। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় জরুরি বহুমুখী প্রকল্পের জন্য ৪০ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু সেই অর্থ ব্যয় হয়নি। তেমনিভাবে কাঁচপুর-সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চারলেন নির্মাণ প্রকল্প, রেলের খুলনা টু দর্শনা জংশনে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ রেলের ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ, আশুগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নদীবন্দর স্থাপনসহ অনেক প্রকল্পে অর্থ পড়ে ছিল। দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর উন্নয়নে চলমান প্রকল্পগুলোতে কোনো অর্থই খরচ করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো।

বিশেষজ্ঞরা এবং পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির অভিমত হলো, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাব রয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও সঠিকভাবে তদারকি করে না। যার কারণে মাঠপর্যায়ে প্রকল্পের কাজে অনেকটা ধীরগতি থাকে। অর্থবরাদ্দ নিয়েও তারা ঠিক মতো ব্যয় করতে পারে না। প্রতি বছরই এডিপি পর্যালোচনার সময় একই সমস্যা দেখা যায়। কিন্তু কোনো উত্তরণ ঘটছে না।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও বতর্মানে পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সময় লেগে যায়। আবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরও সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আরো সময়ক্ষেপণ হয়। এসব প্রকল্পের ভিন্নতা অনুযায়ী সমস্যা। কোনো ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা। সেই জন্য বিমানবন্দর, নির্মাণ প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ একটা সমস্যা হয়। এটা সরকার বলেছিল, কিšুÍ করেনি। তখন সিদ্ধান্ত ছিল যে জমি অধিগ্রহণ যদি কোনো প্রকল্পে থাকে, তাহলে ওই সমস্যা সমাধান না হলে প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদন পাবে না। জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করেই ডিপিপি একনেকে পাঠাতে হবে। কিন্তু এখন এসব আর দেখা হচ্ছে না। তাড়াহুড়া করে প্রকল্প অনুমোদন নেয়া হয়। ফলে পরে জটিলতা দেখা দেয়। তখন তো অর্থ ব্যয় করার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, প্রকল্পে পরিচালকসহ বিভিন্ন লোক দরকার। দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংক থেকে অনুমোদন হলো, একনেক থেকে অনুমোদন হলো, অর্থও ছাড় হলো। তারপরও প্রকল্প বসে থাকে। কারণ এখানে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে। তিনি বলেন, প্রকিউরমেন্ট নিয়ে জটিলতা। আমাদের এখানে ই-জিপি আসা সত্ত্বেও প্রকিউরমেন্টে জটিলতা কাটেনি। জটিলতা হয়তো ভিন্ন রূপ নিয়েছে। এসব জটিলতার কারণে প্রকল্প যখন দেরিতে শুরু হয় তখন প্রকল্প ব্যয় বদলে যায়। তখন আবার ডিপিপি সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তার মানে আরেকটা বছর আটকে গেলে। ওই সময়ের বরাদ্দ থাকলেও তারা ব্যয় করতে পারবে না।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/511663