২৪ জুন ২০২০, বুধবার, ১:৪৯

রাজধানীতে যত্রতত্র বিক্রি

মানহীন সুরক্ষাসামগ্রীতে বাড়ছে করোনার ঝুঁকি

মানহীন সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবহার করোনাভাইরাসের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজধানীর যত্রতত্র এসব সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। কেউ কেউ রাস্তার পাশে, কেউ ভ্যানে আবার কেউ ঝুড়িতে সার্জিক্যাল মাস্ক, পলিথিনের হ্যান্ড গ্লাভস, সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভস, ফেস-শিল্ড, সার্জিক্যাল ক্যাপ, পিপিই, সাধারণ মাস্ক বিক্রি করছেন।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ‘করোনা প্রতিরোধ সামগ্রী’র রীতিমতো বাজার বসছে। বিক্রিও হচ্ছে বেশ। ক্রয়-বিক্রির সময় সামাজিক দূরত্ব মানারও বালাই নেই। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা জানান, কঠিন এ সময়ে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হতে পারে এমন উদাসীনতা। যততত্র এ ধরনের মানহীন সুরক্ষাসামগ্রী সুরক্ষা নয়, বিপদ ডেকে আনবে।

মঙ্গলবার পুরান ঢাকার বাবুবাজার, নাজিরাবাজার, মিডফোর্ড এলাকায় দেখা যায়, মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই থেকে শুরু করে হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী পাইকারি বিক্রি হচ্ছে। এসব পণ্য যে মানহীন, তা দেখলেই বোঝা যায়।

তাছাড়া এসব সামগ্রী বিক্রির অনুমোদনও নেয়া হয়নি। কিন্তু নির্বিকার সংশ্লিষ্টরা। এভাবেই অনুমোদনহীন এবং মানহীন সুরক্ষা সামগ্রী রাজধানীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। যাচ্ছে মফস্বল শহরেও। একসময় যারা ফুটপাতে হকারি করতেন, তারাই এখন সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রেতা বনে গেছেন।

বাবুবাজার ফ্লাইওভারের দু’পাশ এবং আশপাশের রাস্তা ঘিরে সকাল থেকেই বসে সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রির হাট। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও ক্রেতারা আসছেন অস্থায়ী এ হাটে। মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে ফেস মাস্কসহ বিভিন্ন ধরনের করোনা সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি করেন বিল্লাল হোসেন। পাশেই উন্মুক্ত ডাস্টবিন, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

এলোমেলোভাবে পড়ে আছে মলমূত্র। সেখানে দাঁড়িয়েই হাঁকডাক করছেন বিল্লাল। বিল্লাল জানান, আগে ভ্যান চালাতেন। এখন সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি করছেন। নিজের কোনো পুঁজি নেই। এক ব্যবসায়ী থেকে প্রতিদিন নির্ধারিত দামে পণ্য নিয়ে আসেন। যার কাছে যেমন দামে বিক্রি করতে পারেন, তাতেই লাভ থাকে অর্ধেকের বেশি।

তার নিজের মুখেই মাস্ক নেই। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ক্রেতাদের সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলতে হয় বলে মাস্ক পরতে পারি না।’ এদিকে ক্রেতাদের অনেকের মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। ক্রেতা-বিক্রেতাকে মাস্ক খুলেই দাম-দর করতে দেখা গেছে। ফেস মাস্কসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের মাস্ক বিক্রি করেন হিরণ মিয়া।

তিনি জানান, আগে লঞ্চে মাল উঠনো-নামানোর কাজ করতেন। এখন কাজ নেই। বাধ্য হয়েই এ ব্যবসায় নেমে পড়েেেছন। দেড় মাস ধরে ব্যবসা করছেন। তিনি জানান, এখানে যারা ব্যবসা করছেন, কেউই আসল ব্যবসায়ী নন। সবাই নতুন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে মাল পৌঁছে দেন।

এক প্রশ্নের জবাবে হিরণ মিয়া বলেন, ‘অনুমোদন আছে কি নেই, কিংবা মানসম্মত কি না, তা দেখার সময় আমাদের নেই। অনুমোদন কিংবা মানহীন পণ্য যদি হতো তাহলে এ বাজার কী করে বসলো। পুরো বাজারে উপচে পড়া ভিড়। নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়ছে।’

নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী জালাল মিয়া জানান, তিনি এখান থেকে ২ মাস ধরে সুরক্ষা সামগ্রী কিনে নিয়ে এলাকায় বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, ‘এখানকার কোনো পণ্যেরই মান নেই। তারপরও দেদার বিক্রি হচ্ছে। এখান থেকে পণ্য নিয়ে বিভিন্ন ফার্মেসি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি।’

এই এলাকায় সারি সারি বক্সে ভরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীর। কিন্তু পণ্যের গায়ে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। নেই বিএসটিআই’র অনুমোদন। এক ব্যবসায়ী বলেন, যত চান ততই দিতে পারব। ইচ্ছে করলে শুধু খালি বোতলও কিনতে পারেন। সঙ্গে গ্যালনে করে স্যানিটাইজার কিনে নিয়ে যান, আমাদের কাছে সবই আছে। এমন কথাবার্তার ফাঁকেই এক ক্রেতা ২শ’ বোতল কিনে নিলেন।

শুধু পুরান ঢাকা নয়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফুটপাতে-ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে এসব সামগ্রী। টিকাটুলি, মতিঝিল, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া এলাকায় রাস্তার পাশে বিক্রি হচ্ছে। গুলিস্তানে রাস্তার দু’পাশে যেন বিক্রির প্রতিযোগিতা। কে কার চেয়ে কম দামে বিক্রি করবে, সেই প্রতিযোগিতা। ভ্যানে করেও এসব পণ্য বিক্রি করতে দেখা গেছে। এদের অনেকেই আগেও ফলমূল-সবজি বিক্রি করতেন।

এ বিষয়ে কার্ডিওলজি বিশেষজ্ঞ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তৌফিকুর রহমান ফারুক যুগান্তরকে বলেন, এভাবে ফুটপাতে সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি আমাদের কঠিন বিপদে ফেলে দেবে। কারণ এগুলো মানহীন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুমতি না নিয়েই এগুলো বিক্রি হচ্ছে। আর যারা বেচাকেনা করছেন, তারা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।

ময়লা-আবর্জনা পরিবেশে সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রি করা মানেই হচ্ছে সেসব পণ্যে আর সুরক্ষা রইল না। মিডিয়ায় দেখতে পাচ্ছি রাজধানীর ফুটপাতে, অলিগলিতে তো বটেই, বিভিন্ন ফার্মেসি এবং নামসর্বস্ব অনলাইন শপেও পাওয়া যায় এসব পণ্য। এসব সামগ্রী যারা ব্যবহার করছেন, তারা ধরে নিচ্ছেন সুরক্ষায় আছেন।

অর্থাৎ অজান্তেই তারা নিজের ক্ষতি করছেন। জানতে চাইলে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল হাশেম শেখ বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেকে আক্রান্ত হয়ে আমাদের কাছে আসছেন। আবার অনেকে উপসর্গ নিয়ে আসছেন। এসব রোগী মাস্কসহ সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করে আসছিলেন।

তারপরও তারা আক্রান্ত হয়েছেন। এখানেই উদ্বেগের বিষয়। নিুমানের নকল মানহীন সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করার কারণেই তারা বিপদে পড়ছেন। তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধে সুরক্ষা সামগ্রী হতে হবে যথাযথ এবং অনুমোদিত। কাপড়ের মাস্কও পরা যায়, কিন্তু তা যেন ভালো হয়। ফুটপাতের যেন না হয়। প্রয়োজনে ঘরেই এসব মাস্ক তৈরি করা যায়। তিনি আরও বলেন, যে হারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, সুরক্ষা সামগ্রী যদি নকল আর ভেজাল হয়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/318985/