রাজধানী মুগদা হাসপাতালে করোনা টেস্টের জন্য সন্তানকে কোলে নিয়ে এসেছেন বাবা-মা। মঙ্গলবারের ছবি, যুগান্তর
২৪ জুন ২০২০, বুধবার, ১:৪৭

হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা

চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংকট

আক্রান্ত ১১২৬ চিকিৎসক ২৪৬৫ স্বাস্থ্যকর্মী * আইসিইউ পরিচালনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব * সাত দিন দায়িত্ব পালন শেষে ১৪ দিনের আইসোলেশন * প্রয়োজন তিনগুণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী * নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও নার্সদের পদায়ন যথাযথ হচ্ছে না

ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে করোনা মহামারী মোকাবেলায় হাসপাতালে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট প্রকট হচ্ছে। রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে এরই মধ্যে ১১২৬ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময়ে নার্সসহ আড়াই হাজার স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়েছে।

প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এরা পর্যায়ক্রমে কাজের বাইরে থাকছেন। কর্মরতরা সাত দিন দায়িত্ব পালন শেষে নিয়মানুযায়ী ১৪ দিনের আইসোলেশনে যাচ্ছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে একজন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে দুই শিফটে কাজ করতে হচ্ছে।

দায়িত্ব পালনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেয়ে এগিয়ে আছেন তরুণরা। এতে আইসিইউ পরিচালনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট দেখা দিয়েছে। সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।

এ পরিস্থিতিতেও মহামারী মোকাবেলায় নতুন নিয়োগ প্রাপ্ত দুই হাজার চিকিৎসক ও পাঁচ হাজার নার্সকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে যথাযথভাবে পদায়ন করা হয়নি।

পদায়নের ক্ষেত্রেও দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সঠিক স্থানে পদায়ন না হওয়ায় নিয়োগের উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক যুগান্তরকে বলেন, সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সেগুলো সমন্বয় করা হচ্ছে। সমন্বয়ের কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আশা করছি, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাধারণ সময়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাস্তবে তা না থাকায় উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা প্রায় হচ্ছেই না।

কয়েকটি জেলায় সীমিত পরিসরে এবং বিভাগীয় পর্যায়ে কিছু চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। বেশি ভিড় হচ্ছে ঢাকায়। কিন্তু ঢাকায় কোভিড নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসক ও নার্সের আনুপাতিক সমন্বয় নেই।

কোথাও চিকিৎসক এবং নার্সের পদে সমানসংখ্যক কর্মী, কোথাও বা চিকিৎসকের চেয়ে নার্স কম পদায়ন করা হয়েছে। ফলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

ডক্টরস ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ-এর সমন্বয়কারী ডা. অনুপম দাশ যুগান্তরকে বলেন, প্রথম থেকেই কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো দরকার ছিল। এসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক পদায়ন করা না হলে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, ঢাকার ১৫ হাসপাতাল ও আইসোলেশন সেন্টারে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। এসব হাসপাতালে চিকিৎসক আছেন ২০৩০ জন, নার্স ২৪৯৩ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আছেন ২২২৯ জন।

স্বাভাবিক সময়ে এই সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্স দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কোভিড মোকাবেলায় এসব হাসপাতালে আরও বেশি চিকিৎসক ও নার্স পদায়ন জরুরি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর তথ্যমতে, এ পর্যন্ত আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ১১২৬ জন, নার্সের সংখ্যা ৯৭২ জন, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ১৪৯৩ জন।

তাছাড়া প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সংখ্যায় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে হাসপাতালগুলোয় একটি সংকটময় পরিস্থিতি থেকেই যাচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, একটি দেশে প্রতি একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এই অনুপাত ১:০.৫৬। চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালে তাদের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি নার্স থাকা প্রয়োজন।

বর্তমানে অপ্রতুল নার্স দিয়ে চলছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত। এরপরও নার্সরা যথাসাধ্য সেবা দিলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ আছে।

দেশের নার্সিং ব্যবস্থাকে উন্নত করতে পারলে স্বাস্থ্য খাতের আমূল পরিবর্তন আনা যাবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার মানুষের বিপরীতে চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফেরি সংখ্যা ভারতে ২৪ দশমিক ১ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ৬, নেপালে ৬ দশমিক ৭ এবং বাংলাদেশে ৬ দশমিক শূন্য ৬ জন।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (স্বানাপ)-এর মহাসচিব ইকবাল হাসান সবুজ যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর মহানগরসহ অনেক হাসপাতালে চিকিৎসকের চেয়ে নার্সের সংখ্যা কম। মহানগর হাসপাতালে নার্স আছেন মাত্র ৪৫ জন।

এদের মধ্যে একটি অংশ সব সময় আইসোলেশনে থাকেন। বাকিদের তিন শিফটে ভাগ করে কাজ করতে হয়। এতে অনেকেরই এক দিনে দুই শিফট কাজ করতে হচ্ছে। ফলে তাদের পক্ষে সর্বোচ্চ সেবা দেয়া সম্ভব হয় না।

এই নার্স নেতা বলেন, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ৫ হাজার নার্স নিয়োগ প্রদান করেছেন। যাদের কোভিড হাসপাতালে সংযুক্ত দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু একটি মহল অর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ নার্স ঢাকার বাইরে পদায়ন করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি যে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ হয়েছে তার মধ্যে একটি বড় অংশ বসুন্ধরা হাসপাতালে ও সিটি কর্পোরেশন হাসপাতালে পদায়ন করা হয়েছে।

ঢাকার ১৪টি কোভিড হাসপাতালে স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসক সংযুক্তি দিয়ে বাকিদের প্রত্যেক জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে নিযুক্ত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটি (এফডিআরএস)- এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, কোভিড নিয়ে একটি অব্যবস্থাপনা চলছে।

প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী পদায়ন করা হচ্ছে না। ফলে একটি সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এতে অনেক স্থানে চিকিৎসকরাও সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন। তিনি অবিলম্বে এই সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

আইসিইউ পরিচালনায় ডাক্তার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে জানা গেছে। প্রাণঘাতী করোনার সংক্রমণে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রায় রোগীই মারা যাচ্ছেন শ্বাসকষ্টের শিকার হয়ে।

আশঙ্কাজনক অবস্থায় রোগীদের প্রয়োজন হয় আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। অনেক ক্ষেত্রে কৃত্তিম শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করতে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনায় আক্রান্ত শতকরা ২০ জনের জন্য হাসপাতালে চিকিৎসার দরকার হয়।

এর মধ্যে ১০-১৫ ভাগের দরকার হয় অক্সিজেনের। তাদের পাঁচ থেকে ১০ ভাগের অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। তাদের জন্য আইসিইউ সাপোর্ট দরকার হয়। এই আইসিইউ পরিচালনা করার জন্যই এনেসথেসিওলজিস্ট প্রয়োজন।

এ ছাড়া অন্যরা এটি পরিচালনা করতে পারেন না। ন্যূনতম ছয় মাস থেকে এক বছরের প্রশিক্ষণ ছাড়া কেউ আইসিইউ পরিচালনা করতে পারবেন না।

সরকারি চাকরিতে এনেসথেসিওলজিস্টের অভাবের কারণেই বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় আইসিইউ স্থাপন ও পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

সরকারি হিসাবমতে, সারা দেশের কোভিড-১৯-এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ শয্যা আছে ৩৪১টি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েক সপ্তাহে করোনা রোগীর সংখ্যা অর্ধলক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

সেই তুলনায় আইসিইউ শয্যা খুবই কম। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা বিষয়ে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ কিছু করেছে।

সরকারের কাছে করা ওই সুপারিশে এনেসথেসিওলজিস্ট নিয়োগের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, করোনা রোগীদের সেবার জন্য আইসিইউ সুবিধা বাড়াতে হবে। রোগীকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অক্সিজেন দিতে ভেন্টিলেটর বাড়াতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/318971/