২৩ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ১:০০

বিলম্বিত রিপোর্ট নিয়ে জটিলতা

করোনার নমুনা পরীক্ষা এখনও লক্ষ্যহীন

করোনার সংক্রমণ শুরুর সাড়ে তিন মাসেও স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারেনি। খুবই এলোমেলো অবস্থায় নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। যে পরিস্থিতিতে চীন তাদের এক শহরে দৈনিক ১০ লাখ নমুনা পরীক্ষা করেছে, প্রায় একই অবস্থায় বাংলাদেশে পরীক্ষা হচ্ছে দিনে ১৪-১৫ হাজার নমুনা।

এতে দেশে আক্রান্তের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট দিতে দেরি হচ্ছে। ফলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আবার নমুনা সংগ্রহের সরঞ্জাম এবং পরীক্ষার কিটের স্বল্পতাও জটিলতার অন্যরকম কারণ। সব মিলে স্বাস্থ্য বিভাগের সক্ষমতার অভাবের বিষয়টি দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ্যে চলে আসছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত ল্যাব এবং দক্ষ জনবল না থাকায় লক্ষ্য নির্ধারণ করে নমুনা পরীক্ষায় নামতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। ঠিক একই কারণে অধিকাংশ সময় দ্রুত পরীক্ষার রিপোর্টও দিতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বড় সমস্যা হচ্ছে কোভিড-১৯-এর মতো মহামারী মোকাবেলায় কেন্দ্রীয়ভাবে কাজের সমন্বয় হচ্ছে না।

তারা বলেন, নমুনা পরীক্ষার জন্য সাধারণ মানুষ ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। এ কারণে কিছু ক্ষেত্রে অনেক বেশি নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে। কিন্তু ল্যাবের অভাবে পরীক্ষা করা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হচ্ছে- তারা সংগৃহীত নমুনা পরদিন পরীক্ষার জন্য রেখে দিয়েছেন।

এজন্য রিপোর্ট দিতে দেরি হচ্ছে। এতে নমুনা নেয়ার পর দিন যদি কেউ নতুনভাবে আক্রান্ত হন তিনি শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারও কারও প্রথমে ফল নেগেটিভ আসছে, পুনঃপরীক্ষায় সেই রিপোর্টই আবার পজিটিভ হচ্ছে।

সকালে যদি নেগেটিভ বলা হয়, হয়তো পরদিন সেটাই পজিটিভ বলা হচ্ছে। আবার ফল হাতে না পেলে কোনো হাসপাতাল রোগী ভর্তি করাতে চাইছে না। সময় মতো করোনা পরীক্ষা ও এর ফল পেতে দেরি হওয়ায় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে মানুষের মধ্যে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, পরীক্ষায় সাময়িক সমস্যার কারণ চাহিদা অনুযায়ী কিট পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমান বিশ্বের সব দেশেই কিটের চাহিদা রয়েছে। তবে যা মজুদ আছে তাতে ঘাটতি হওয়ার কথা না।

কোনো কারণে সংকট তৈরি হলেও তা খুব দ্রুতই মেটানোর ব্যবস্থা সরকারের হাতে রয়েছে। কাজেই কিট নিয়ে এ মুহূর্তে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে দেশে ৬২টি ল্যাবরেটরিতে করোনাভাইরাসের নমুনা শনাক্ত করা হচ্ছে। তবে টেকনিক্যাল সমস্যার কারণে দুটি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা না হওয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৬০টিতে মোট ১৫ হাজার ৫৮৫টি নমুনা টেস্ট হয়। তালিকায় দেখা গেছে, ৬০টি ল্যাবের মধ্যে মাত্র ১০টি ল্যাবের প্রতিটিতে ৩ শতাধিক নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। বাকিগুলোতে শূন্য থেকে দুই শতাধিক নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

অল্প পরীক্ষার কারণে অনেক সময় ল্যাবগুলোতে পরীক্ষার জন্য নমুনা স্তূপ হয়ে যায়। পরীক্ষার চাপ বাড়ায় এক ল্যাবের নমুনা পাঠাতে হচ্ছে আরেক ল্যাবে। তবে ঢাকার বাইরে রোগী শনাক্তে পরীক্ষার হার খুবই কম। এ পরিস্থিতিতেও সক্ষম দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে না। তারা বলেন, সরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা হাসাপাতালে পরীক্ষার সুযোগ তৈরি করা সম্ভব।

গত সাড়ে তিন মাসে স্বাস্থ্য বিভাগ এ প্রস্তুতিগুলো সম্পন্ন করতে পারত। তাহলে অনেক বেশি পরীক্ষা করা সম্ভব হতো। এতে আক্রান্তের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যেত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি অনুযায়ী নমুনা পরীক্ষার হার প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছতে পারছে না।

ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, নমুনা সংগ্রহ পরীক্ষা জটিলতার প্রধান সমস্যা বিদ্যমান পিসিআর মেশিনের ক্যাপাসিটি। দ্বিতীয়ত পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল না থাকা। তাছাড়া মানুষ এখন পরীক্ষা করানোর বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহী। ফলে নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে বেশি।

এছাড়া ঢাকার বাইরের অনেক ল্যাবের সক্ষমতা না থাকায় তারা সংগৃহীত নমুনা ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। এতে নমুনা জট লাগছে। রংপুর, রাজশাহী, সিলেটের বেশিরভাগ নমুনা ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে। এসব নমুনার ফলাফল স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তারা রোগীদের কাছে পাঠায়। এসব কারণে রিপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে।

তবে নমুনা পরীক্ষা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে একাধিক নতুন পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর- এমনটি জানিয়েছেন মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। সোমবার নিজ কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, দেশের প্রতিটি জেলায় আরটিপিসিআর মেশিন স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি একই পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা কমাতে এন্টিবডি ও এন্টিজেন পদ্ধতিতে পরীক্ষা চালুর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

এছাড়া জিনেক্সপার্ট মেশিন ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সক্ষমতা অনেক কম, তাছাড়া সবই আমদানিনির্ভর। তাই আমদানি প্রক্রিয়ায় বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। স্বল্প সময়েই হয়তো সব ব্যবস্থা শুরু করা সম্ভব হবে।

কিটের সংকটের স্বল্পতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের ল্যাবগুলোতে কিটের যে জোগান রয়েছে তাতে আরও দুই থেকে তিন দিন চলবে। এরই মধ্যে আগামীকাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া ৬৮ হাজার কিট এসে পৌঁছবে এবং পরশুদিন আমদানিকৃত ৪০ হাজার কিট দেশে আসবে। কিটের নিয়মিত জোগান এভাবে চলমান থাকবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র নমুনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে অনেককেই পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ভোগান্তি আরও বেশি। ফল পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে অনেককে। অপেক্ষা করেও অনেকে পরীক্ষাই করাতে পারছেন না। রাজধানীর মহানগর প্রজেক্টের এক বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, সাত দিন হল তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির বুথে নমুনা দিয়ে এসেছেন।

এখনও কোনো ফল পাননি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাড্ডা এলাকার একজন জানান, মুগদায় তিনি এ পর্যন্ত দুইবার নমুনা দিয়েছেন কিন্তু কোনো ফল পাননি। প্রথমবার নমুনা দেয়ার ৯ দিন পরেও ফল না পেয়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করান।

কিন্তু কোনো ফল পাননি। অথচ এ কারণে তিনি কাজে যোগদান করতে পারছেন না। এ সমস্যা এক বা দুইজনের নয়, প্রতিদিন প্রায় হাজার মানুষকে এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা দেশ থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে দক্ষ জনবল সংকটে পড়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সীমিতসংখ্যক সরকারি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে নমুনা সংগ্রহের কাজ সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর পরিস্থিতি সামাল দিতে তাড়াহুড়ো করে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের হেলথ প্রোভাইডারদের সম্পৃক্ত করার ঘোষণা দিয়েও স্বাস্থ্য অধিদফতর সমালোচনার মুখে পড়েছে।

কারণ নমুনা সংগ্রহের কাজটি মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পক্ষেই দক্ষতার সঙ্গে করা সম্ভব। আর নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা পরিচালনা, ফল জানানো এবং শনাক্ত ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনার বিষয়গুলো খুবই জরুরি।

তাছাড়া অনেক জায়গায় নমুনার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক সময় মানসম্পন্ন নমুনা আসছে না। অর্থাৎ নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পাত্রজাত করা এবং নমুনা পাঠানোর ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান সমস্যা প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এবং টেস্টিং কিটের অপর্যাপ্ততা। তিনি বলেন, শুধু ল্যাবের সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, দক্ষ জনবল না থাকলে ল্যাব চালানো সম্ভব হবে না।

তাই বিকল্প উপায়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে সিটিস্ক্যান করে দেখা যেতে পারে। চীনসহ অনেক দেশেই এটা করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এর অনুমোদন দিয়েছে। তবে আমাদের দেশে এটির সুযোগ খুবই সীমিত। তাই আমরা চেস্ট এক্সরের মাধ্যমে পরীক্ষা করতে পারি। সেটি সহজলভ্য এবং ব্যয়বহুল নয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/318645/