২১ জুন ২০২০, রবিবার, ৪:২৫

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতা

করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন

মহামারীর ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেননি: যথাসময়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি * বিদেশ ফেরতদের পরীক্ষা, কন্টাক্ট ট্রেসিং গুরুত্ব পায়নি * রোগী ভর্তি, আইসিইউ, ভেন্টিলেশন, অক্সিজেন নিয়ে হাহাকার দূর হয়নি

স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতা, স্বেচ্ছাচারিতা, সিদ্ধান্তহীনতা, উদাসীনতা ও সমন্বয়হীনতায় দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। বিশ্বে ৬ মাস এবং বাংলাদেশে ৩ মাসের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেনি। তারা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না-পারায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

প্রতিদিনই বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। আক্রান্ত ও সন্দেহভাজনরা পরীক্ষা করাতে পারছেন না। তাদের অনেকেই হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা রোধে প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। প্রথম ভুল হচ্ছে বিমানবন্দরে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা।

তাদের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে শুরু করলেও কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ উপেক্ষা করে নমুনা পরীক্ষায় শিথিলতা দেখানো হয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত একটি কেন্দ্রে পরীক্ষা ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ রাখা হয়। হাসপাতালে আইসিইউ, ভেন্টিলেশন এবং অক্সিজেনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে না পারায় রোগী ও স্বজনদের হাহাকার থামেনি।

অধিকসংখ্যক হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ করে এ ধরনের মহামারীতে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, সে জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন-সেটাই অনুমান করতে পারেননি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকরা। অথচ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সুরক্ষাসামগ্রী কেনাকাটা, টেকনোলজিস্ট নিয়োগ, নার্সিং পদায়ন নিয়ে দুর্নীতি জড়িয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের ভুলেই দেশে করোনার সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী।

তারা বলেন, করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালগুলো কতটা প্রস্তুত, তা দেখতে অনুসন্ধান চালিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। এতে হাসপাতালগুলোর করুণ চিত্র উঠে এসেছিল। আইসিইউ, ভেন্টিলেশন, অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্বল্পতার বিষয়গুলো সরকারি অনুসন্ধানে উঠে আসে। ভাইরাসটি ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার আগেই হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হলে করোনা রোগীদের দুর্ভোগ কমত। কিন্তু বাস্তবে তা করা হয়নি। ফলে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন অনেক করোনা রোগী।

এসব প্রসঙ্গে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটাস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটি-এফডিআরএসের উপদেষ্টা ডা. আবদুর নূর তুষার বলেন, অনভিজ্ঞতাই এই পরিস্থিতির মূল কারণ। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বেশকিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু অনেক দেরিতে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়ায় সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এগুলো মূলত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপকদের ত্রুটি। তারা অগ্রসর হয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করেননি। ফলে গৃহীত উদ্যোগগুলো ফলপ্রসূ হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ করোনা দুর্যোগকে প্রথম থেকে ভূমিকম্প, সাইক্লোন, বন্যার মতো দুর্যোগ মনে করেছেন। তারা এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝতেই পারেননি। যে কারণে আমরা প্রথম সংক্রমণের ধাক্কাতেই বেসামাল হয়ে পড়েছি। মহামারীর যে কোনো পর্যায়ে সংক্রমণ ঠেকাতে কিছু মৌলিক কাজ করতেই হয়। যেমনটা চীনসহ অনেক দেশই করছে। কিন্তু আমাদের এখানে তেমনটা হয়নি বলে আজ এ অবস্থা।

তারা বলছেন, প্রথম থেকে যে কাজগুলো না করায় আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম বিমানবন্দরে বিদেশ ফেরতদের সঠিকভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। তাদের ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনভাবে দেশব্যাপী ঘোরাফেরার সুযোগ করে দেয়া হয়। এদের মাধ্যমে যখন ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে তখনও কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়নি।

ফলে দেশে পারিবারিক ও সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম থেকেই নমুনা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। দেশে মার্চ মাসের ৮ তারিখ প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। এরপর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত একটি মাত্র কেন্দ্রে পরীক্ষার ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো বা এ সংক্রান্ত প্রস্তুতিও গ্রহণ করা হয়নি। এতে শনাক্ত হয়েছে কম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভাইরাসটি ব্যাপক হারে ছড়িয়েছে। তবে এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ল্যাবের সংখ্যা। বর্তমানে ৬১ ল্যাবে পরীক্ষা চলছে। এতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।

পিসিআর পরীক্ষায় যেসব রোগীর করোনা পজিটিভ আসবে তাদের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে শুরুতে তা নির্ধারণ করা হয়নি। যদিও বিশেষজ্ঞরা প্রথম থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় থেকে সে ধরনের উদ্যোগ ছিল খুবই সীমিত।

প্রথম ধাক্কায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাসামগ্রীর অভাব দেখা দেয়। ফলে শুরুতেই অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাদের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম কেনা শুরু হলে, এ নিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

প্রথমদিকে মাদারীপুরের শিবচর ও মিরপুরের টোলারবাগ লকডাউন করা হয়। এটা যথাযথভাবেই কার্যকর হয়। কিন্তু এরপর থেকে গত দু’মাস লকডাউন নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। কোন এলাকা কীভাবে অবরুদ্ধ করলে কাজ হবে-সে ধরনের নকশাও তৈরি হয়নি। ফলে দুই মাসের বেশি সময় সাধারণ ছুটির পর সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ফের বিভিন্ন এলাকা লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এটা কীভাবে কার্যকর করা হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় ঢাকা দুই সিটির ৪৫ এলাকা লকডাউন কার্যকর হচ্ছে না।

বিশ্বে করোনার আগ্রাসন ইতোমধ্যে ৬ মাস পার হতে চলেছে। দেশেও ৩ মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত হয়নি। দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের কোনো কোভিড হাসপাতালে পদায়ন করা হয়নি। এমনকি কোন পর্যায়ে দেশে কতটি পরীক্ষা করা হবে, সেটি নির্ধারণ হয়নি বা সে ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়নি।

প্রসঙ্গত চীনের উহানে দৈনিক এক মিলিয়ন নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। সর্বোপরি দেশের এই মহামারী নিয়ন্ত্রণের নামে যারা বিভিন্ন অনিয়ম, অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে তাদের কোনো শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে।

করোনা সংক্রান্ত কাজে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলা করতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি কমিটি করা হয়েছে। সবচেয়ে বড়টির নাম ‘ন্যাশনাল কমিটি ফর প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অব কোভিড’। এই কমিটির প্রধান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। প্রথমদিকে তিনি একের পর এক অবৈজ্ঞানিক তথ্য প্রদান করেন।

পরবর্তী সময়ে তাকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ অপর কমিটির নাম ‘ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অব কোভিড-১৯’। আরেকটি কমিটির নাম ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’। এই কমিটির প্রধান বিএমডিসির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ তিনি একাধিকবার বলেছেন, ‘আমরা পরামর্শ দিই কিন্তু কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে না।’

ইতঃপূর্বে যুগান্তরের কাছে একই ধরনের মন্তব্য করেছে পৃথক দুটি কমিটির দুই সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এবং অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলান। তারা বলেন, ‘আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে যেসব পরামর্শ দিয়েছি, সেগুলো তারা আমলেই নেননি।’

এ প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, রাজধানী বেইজিংয়ে দীর্ঘ ৫০ দিন পর সম্প্রতি আবার দু’জন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী পাওয়া গেছে। এরপর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১১টি এলাকা লকডাউন করা হয়। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়, সেনা-পুলিশ টহল শুরু হয়েছে, গণপরিবহন এবং স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

দু’জনের কন্টাক্ট ট্রেসিং করে ইতোমধ্যে ৫১৭ জনের পিসিআর করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৫ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ এসেছে (সবাই লক্ষণহীন)। এ থেকে বোঝা যায়, করোনা মোকবেলায় কী ধরনের পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা দরকার। অথচ অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ঢাকার রাজাবাজার লকডাউন করা হল। কিন্তু সেই এলাকায় টেস্ট, ট্রেসিং কিছুই হল না।

ডা. জাহিদ বলেন, আমরা যে ধরনের লকডাউন দিচ্ছি, সেটা কিছু হচ্ছে না, হবেও না। জোড়াতালি দিয়ে সব কাজ হয় না। ছোট-বড় কোনো এলাকাই লকডাউন করে লাভ হবে না, যদি সেই এলাকার প্রতিটি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত না করা যায়, আক্রান্তদের আইসোলেট করা না যায়।

এতে শুধু মানুষের দুর্ভোগই বাড়বে, ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু সরকারি বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কিছুটা সময় লেগেছে।

পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, দেশে স্বল্পসংখ্যক পিসিআর মেশিন ছিল। পরে দ্রুত মেশিন কেনার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে এখন পরীক্ষার হার বেড়েছে। তিনি বলেন, তারা এই পরিস্থিতি উত্তরণে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/317914/