২১ জুন ২০২০, রবিবার, ৪:২৩

৬ মাস পর টাকা ছাপিয়ে বেতন দিতে হবে

বাজেট নিয়ে সিপিডির ভার্চুয়াল সংলাপে আহসান এইচ মনসুর

সরকার যেভাবে চলছে তাতে ৬ মাস পর টাকা ছাপিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান হাবিব (এইচ) মনসুর। তিনি বলেছেন, এটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। তবে এ সময় এখনো আসেনি। কিন্তু বেশি দূরে নয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকারকে রুটিন বাজেট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা এতদিন বাজেটের বিষয়ে যে পরামর্শ দিয়েছেন তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গতকাল শনিবার ‘সিপিডির বাজেট সংলাপ ২০২০’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে তারা এই মন্তব্য করেন। সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সংলাপ সঞ্চালনা করেন নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।

ধারাবাহিকভাবে এই সময়ে ১ বছরের বাজেট করা উচিত হয়নি উল্লেখ করে আহসান এইচ মনসুর বলেন, বরং ৬ মাস অন্তর দুটি বাজেট করা উচিত ছিল। এর মধ্যে প্রথম ৬ মাস করোনা মোকাবেলায়। পরের ৬ মাস করোনা পরবর্তী করণীয় কেন্দ্রিক বাজেট। কিন্তু সরকার তা না করে গতানুগতিকভাবে কেবল জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে প্রাধান্য দিয়েছে বাজেটে। কিন্তু কারোনা ইস্যুকে প্রাধান্য দেয়া হয়নি। এই বাজেট দিয়ে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ তো দূরের কথা পজিটিভ প্রবৃদ্ধিও হবে না।

তিনি বলেন, এবার রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কর পরিধি বাড়ানোর জন্য আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুই ভাগে ভাগ করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সরকার তা করেনি। এনবিআরের কাঠামো সংস্কার করতে বলেছিলাম। কিন্তুতাও বাস্তবে করা হয়নি। ফলে রাজস্ব আদায় হয়নি। সামনেও আদায় সম্ভব না। এ কারণে সরকার এখনি ধারদেনা করে চলছে।

ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনা থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করে আহসান মনসুর বলেন, করোনার কারণে ৬-৯ মাস সময় ধরে যারা বেকার হয়েছেন তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মাসে ৩-৫ হাজার টাকা করে বিশেষ ফান্ড দেয়া যেতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি।

অন্যদিকে, বাজেট পরিবর্তনের এখনো সময় আছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এবারের বাজেট যেন রুটিনের হ্যাঁ জয় যুক্ত হয়েছে এ বাজেট না হয়। যা প্রস্তাব করা হয়েছে তাই পাস হলো সেটা যেন না হয়। বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে যে পরামর্শ ও মতামত দিচ্ছেন এগুলো যেন যোগ করা হয়।

তিনি বলেন, সাধারণত সব সময় রুটিন বাজেট হয়ে থাকে। তবে এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রম হবে এমনটা প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাজেট প্রস্তাবে তা দেখিনি। বাজেটে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকা উচিত ছিল। সেটা এক বছর হোক অথবা বেশি হোক এমন কিছু সংস্কার প্রস্তাব থাকা দরকার ছিল।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংক খাতের যে সংস্কারের কথা বলেছে তার সমালোচনা করে বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, আমরা সংস্কার করেছি। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃ তফসিলের সুযোগ করে দিয়েছি। এটা সংস্কার নয় এটা আরো পিছনে ঠেলে দেয়া। দ্বিতীয়ত, ক্যাপিটাল মার্কেট নিয়ে কিছু সংস্কার করবে বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু উল্টো তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির মধ্যে ট্যাক্সের ব্যবধান কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

সরকারের ব্যাংকঋণ নির্ভরতা ঠিক নয় উল্লেখ করে সাবেক এই গভর্নর বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে অধিক ঋণ না নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বন্ডের মাধ্যমে অর্থ নিতে পারে। তবে সেই ঋণের সুদহার ২, ৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। ৭, ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিলে ব্যাংকগুলো চাপে পড়বে।

ভার্চুয়াল আলোচনায় অংশগ্রহণ করন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নাইম রাজ্জাক এবং মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার নিহাদ কবীর প্রমুখ।

মূল প্রবন্ধে সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণেরও বেশি ধরা হয়েছে। কোভিড-১৯ এখনো চলমান। সুতরাং এটা আমাদের কাছে সঠিক মনে হয়নি। রফতানি প্রবৃদ্ধির টার্গেট করা হয়েছে ১৫ শতাংশ। এ বছর হয়তো ১৮ শতাংশ নেগেটিভ গ্রোথ হবে। তারপরেও লো লেবেল থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করা চ্যালেঞ্জিং হবে।’

তিনি বলেন, ‘রাজস্বের ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ শতাংশের মতো গ্রোথ ধরা হয়েছে- সেখানে বড় অংশই আসবে অপ্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে। এ সময় কর ফাঁকি কমিয়ে কিভাবে ইনকাম ট্যাক্স থেকে বেশি কর নেয়া যেত তা বাজেটে উল্লেখ করা হয়নি। বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নের জন্য ব্যাংক থেকে ৮৭ হাজার কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সরকার এই টাকা নিলে ব্যাংক থেকে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের অর্থ পেতে সমস্যা হবে বলে আমাদের মনে হয়েছে’।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হিসাব মেলানোর জন্য বিদেশী সাহায্য প্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলার। সেটা আমরা সর্বোচ্চ ৮ বিলিয়নের মতো ব্যবহার করতে পেরেছি আগে। সুতরাং ৮ বিলিয়ন থেকে ১১ বিলিয়নে নিয়ে যাওয়া বড় একটা চ্যালেঞ্জ হবে, বিশেষ করে সরকারি প্রজেক্ট বাস্তবায়নের যে ধীর গতি আমরা দেখছি।

তিনি বলেন, অপ্রদর্শিত আয় ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করা যাবে এটা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে কাম্য নয়। মানিলন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে বলা হয়েছেÑ ধরতে পারলে ৫০ শতাংশ জরিমানা করে সেটা আদায় করা হবে। কিন্তু এর আগে ছিল ধরতে পারলে জেল-জরিমানা হবে। সেখান থেকেও এটা কিন্তু এক ধরনের অব্যাহতি দেয়া হলো।

মোবাইল সিমের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো উচিত হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মোবাইল সিমের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় ইন্টারনেটের ব্যবহার কমবে। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা খুব ভালো অবস্থানে আছি। এখানে ইন্টারনেট বড় ভূমিকা রেখেছে। সে দিক থেকে এটা রহিত করলেই ভালো হবে বলে আমাদের মনে হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ‘এডিপিতে ১-২ লাখ টাকার অনেক সিম্বলিক প্রজেক্ট এবারো রাখা হয়েছে। এগুলো ভালো হয়নি। সামাজিক সুরক্ষা আরো বাড়ানো যায় কি না তা পুনরায় পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। ৫০ লাখ মানুষকে যে নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে তার আওতা আমরা আরো বাড়াতে পারি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/509923