১৮ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৬:০১

বোরো সংগ্রহে বেহাল দশা

সরকারি গুদামে ধান-চাল দিতে কৃষকের অনীহা

ধানের টার্গেট ৮ লাখ টন সংগ্রহ ২৯ হাজার টন * চালের টার্গেট সাড়ে ১১ লাখ টন, সংগ্রহ দেড় লাখ টন * গতি বাড়াতে সংগ্রহ নীতিমালা সংশোধন * প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ -খাদ্যমন্ত্রী

কাঙ্ক্ষিত গতি পাচ্ছে না চলতি বোরো মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। দেড় মাসে সারা দেশে মাত্র ২৯ হাজার টন ধান এবং দেড় লাখ টন চাল সংগ্রহ হয়েছে। অথচ সরকারের টার্গেট ৮ লাখ টন ধান এবং সাড়ে ১১ লাখ টন চাল। খোলা বাজারে দাম বেশি পাওয়ায় সরকারি গুদামে ধান-চাল দিচ্ছেন না কৃষক। ফলে বোরো সংগ্রহে বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

সরকারি সংগ্রহের টার্গেট পূরণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এ সংক্রান্ত নীতিমালা সংশোধনও করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত একজন কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ তিন টনের পরিবর্তে ছয় টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, সময়মতো সরকারের টার্গেট পূরণ না হলে ২০১৭ সালের মতো ধান-চালের বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।

এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বোরো সংগ্রহের গতি বাড়াতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এজন্য নীতিমালা সংশোধনও করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে হয়তো কৃষকরা ধান-চাল বিক্রি করছেন না। কারণ ধান-চাল বিক্রি করে কৃষকরা যেসব খাতে খরচ করেন সেসব খাত এখন বন্ধ রয়েছে। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার খরচ, তাদের বিয়ে-শাদিসহ সব ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তাই অনেকে বিক্রি করছেন না। তবে প্রয়োজন হলেই তারা বিক্রি করবেন। বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম বাড়ালে সারা দেশে ভোক্তা সাধারণের ওপর চাপ পড়বে। প্রধানমন্ত্রী তা চান না। তিনি চান, সব সময় ব্যবসায়ীরা কেজিতে ৫-৬ টাকা ব্যবসা করুক। এবার করোনার কারণে ২-১ টাকা ব্যবসা করুক।’

জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে ছয় লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ৩০ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন বোরো ধান-চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি সরকারি গুদাম খালি থাকা সাপেক্ষে আরও ধান-চাল কেনা হবে বলেও কমিটি সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। এরপর আরও দুই লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত দেয় কমিটি।

ফলে চলতি বোরো মৌসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ৮ লাখ টন ধান, ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৫ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার কথা রয়েছে। ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে; যা ৩১ আগস্ট শেষ হবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১৬ জুনের হিসাব অনুযায়ী, দেড় মাসে সারা দেশে ধান সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ২৯ হাজার টন। আর চাল (সিদ্ধ) সংগ্রহ হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার এবং আতপ চাল ১৪ হাজার টন; যা কাঙ্ক্ষিত নয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে খাদ্যমন্ত্রী একাধিকবার মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগ্রহের গতি বাড়াতে তাগিদ দিয়েছেন।

সর্বশেষ ১০ জুন চট্টগ্রাম বিভাগের খাদ্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, ধান-চাল ক্রয়ে সরকারি সংগ্রহের গতি বাড়াতে হবে। এছাড়া নির্দেশ অনুযায়ী খাদ্যশস্যের মান যাচাই করে সংগ্রহ করতে হবে। ধান-চাল কেনায় কেউ অনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।

বোরো সংগ্রহের গতি বাড়াতে ১৪ জুন বোরো সংগ্রহসংক্রান্ত ‘অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালা-২০১৭’ সংশোধন করে একজন কৃষকের কাছ থেকে সর্বোচ্চ তিন টনের পরিবর্তে ছয় টন ধান কেনার বিধান করা হয়।

জানা গেছে, খোলা বাজারে এবার ধানের দাম বেশি। ফলে চাষীরা সরকারি গুদামে ধান দিচ্ছেন না। করোনা পরিস্থিতিতে চালের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। চাল সরবরাহে মিল মালিকরা সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন। মিল মালিকরা খোলা বাজার থেকে ধান সংগ্রহ করায় বোরো ধানের দাম বেড়ে গেছে।

একাধিক খাদ্য কর্মকর্তার আশঙ্কা, সংগ্রহের টার্গেট পূরণ না হলে সরকারি গুদামে মজুদ কমে গেলে ২০১৭ সালের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তাদের মতে, কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা চালের বাজার অস্থির করে তুলতে পারে। ২০১৭ সালে খাদ্য মজুদ মাত্র দেড় লাখ টনে নেমে এসেছিল। তখন চালের বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।

এ ব্যাপারে খাদ্যমন্ত্রী বলেন- না, এবার এমন হবে না। ২০১৭ সালে হাওরে ধানের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছিল। এবার তেমন ক্ষতি হয়নি। ওই সময় সরকারের যথেষ্ট মজুদ ছিল না। এবার মজুদ ভালো। এছাড়া করোনায় ধান-চালের দাম বাড়তে পারে মনে করে বড় বড় কৃষক, ব্যবসায়ী ও আড়তদার ধান-চাল কিনে মজুদ করছেন। কিন্তু তাদের সে ইচ্ছায় গুড়েবালি হবে। সরকার ধান-চালের দাম বাড়াবে না। প্রয়োজনে আমদানি ডিউটি তুলে দেয়া হবে। যেহেতু বাম্পার ফলন হয়েছে সেহেতু একদিন মজুদ ধান-চাল ছাড়তেই হবে। প্রয়োজনে মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা হবে। কোনোভাবে দাম বাড়ানো হবে না।

বোরো সংগ্রহের বেহাল দশা জানিয়ে ঢাকা বিভাগের একজন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি-ফুড) যুগান্তরকে বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী একজন তালিকাভুক্ত কৃষকদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে ধান কেনা হবে। কিন্তু বর্তমান বাজারে ধান-চালের দাম সরকারি দামের চেয়ে কেজিতে ২-৩ টাকা বেশি। তাই তারা সরকারি গুদামে ধান না দিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেকে ধান-চাল বিক্রি না করে সামর্থ্য অনুযায়ী মজুদ করছেন। এছাড়া আড়তদার, ধান-চাল ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছ থেকে কিনে গুদামজাত করছেন। ফলে আমরা ধান পাচ্ছি না। ইতোমধ্যে লটারি ব্যবস্থাও তুলে দেয়া হয়েছে। তাতেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া নেই। সরকার বাধ্য হয়ে সংগ্রহ নীতিমালা সংশোধন করেছে।

সংগ্রহের অবস্থা জানতে চাইলে ময়মনসিংহের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (ডিসি-ফুড) মো. জহিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তার জেলার ধান কেনার টার্গেট ৪৪ হাজার টন। দেড় মাসে মাত্র সাড়ে ৪০০ টন সংগ্রহ করেছেন। ৬২ হাজার টন চালের মধ্যে সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৯ হাজার টন। তিনি জানান, কৃষকরা ধান দিতে না এলে আমরা কি করতে পারি? ধান চলে গেছে আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের হাতে।

খাদ্যমন্ত্রীর নিজের জেলা নওগাঁর ডিসি-ফুড জিএম ফারুক হোসেন পাটোয়ারী জানান, তার জেলায় ৩২ হাজার টন ধান কেনার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র ৭১২ টন কেনা হয়েছে। ৫৫ হাজার টন চাল কেনার টার্গেট থাকলেও কেনা হয়েছে ১১ হাজার টন। বগুড়ার ডিসি-ফুড সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, তার জেলায় প্রায় ৩৫ হাজার টন ধান কেনার কথা থাকলেও এ পর্যন্ত আড়াই হাজার টন ধান কেনা হয়েছে। প্রায় ৭২ হাজার টন চাল কেনার টার্গেট থাকলেও কেনা হয়েছে ১২ হাজার টন। নির্ধারিত সময়ে টার্গেট পূরণ করতে পারবেন বলেও জানান তিনি।

টাঙ্গাইলের ডিসি-ফুড কামাল হোসেন বলেন, তার জেলায় ২৮ হাজার টন ধান কেনার কথা থাকলেও কেনা হয়েছে মাত্র ৩০০ টন। আর ৩০ হাজার টন চালের বিপরীতে কেনা হয়েছে ৫ হাজার টন।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/316965/