১১ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ২:৩৭

ঢাকা-রোম

বিমানের বিশেষ ফ্লাইটের টিকিট নিয়ে ধান্দাবাজি

হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফ্লাইটের টিকিট ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রতারক চক্র। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওই চক্রের সদস্যদের টাকা না দিয়ে বিশেষ ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। অনুসন্ধানে প্রতারক চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কথোপকথনে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। চক্রের সদস্যদের পরিচয়ও উঠে এসেছে। বিমানের ওয়েবসাইটে দেওয়া শিডিউল অনুযায়ী ১৭ জুন ঢাকা-লন্ডন বিশেষ ফ্লাইটের টিকিট বিক্রি ঘিরে অনুসন্ধান চালানো হয়। বিশেষ ফ্লাইটটি ওই দিন ইতালির রোম হয়ে আসবে- মূলত এই প্রচারণা চালিয়েই প্রতারক চক্রের সদস্যরা টিকিটপ্রতি প্রায় ২০ হাজার টাকা অতিরিক্ত নিয়ে ১৪১টি টিকিট বিক্রি করেছে। 'সিরিয়ালে ওপরের দিকে নাম তুলে দেওয়া হবে' এ কথা বলে এখনও আগাম ২০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে।

জানা যায়, আগামী ১২ জুন বিমানের আরও একটি বিশেষ ফ্লাইট ঢাকা থেকে ইতালি যাবে। অতিরিক্ত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে সেই ফ্লাইটের টিকিটও অনেকের কাটতে হয়েছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোকাব্বির হোসেন সমকালকে বলেন, ১৬ কিংবা ১৭ জুন বিমানের কোনো বিশেষ ফ্লাইট ইতালি যাওয়ার বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। তবে ১২ জুনের ফ্লাইট যাবে। যথাযথ নিয়মে নিবন্ধন ও টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইতালি সরকারের অনুমতি নিয়ে বিমানের বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করতে হচ্ছে। ফলে এখানে নিয়মের বাইরে গিয়ে টিকিট কাটার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বিমান কর্তৃপক্ষ বার বার যাত্রীদের অবহিত করছে। এরপরও কেউ যদি প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দেয় তাহলে কী করার থাকে?

ইতালি থেকে অনুসন্ধান শুরু :ইতালি থেকে কয়েকজন প্রবাসীই প্রথম এই প্রতারক চক্রের কর্মকাণ্ডের কথা বলেন। তাদের একজন লাবণ্য চৌধুরী সমকালের সঙ্গে আলাপে জানান, যেসব প্রবাসী ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ইতালি থেকে ঢাকা গিয়েছিলেন, তারাই এখন ফিরতে চান। কারণ ইতালিতে প্রায় সব অফিস, দোকান, কারখানা খুলছে এবং জীবনযাত্রাও স্বাভাবিক হচ্ছে। অনেককে তাদের কর্মস্থল থেকে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফলে তাদের আগ্রহের কারণেই বিমানের এই বিশেষ ফ্লাইট। ১২ জুনের ফ্লাইট ঘিরেই ঘটনার শুরু। লাবণ্য চৌধুরী নিজেও ওই ফ্লাইটের জন্য নিবন্ধন ফরম পূরণসহ নিয়ম

অনুযায়ী টিকিট কাটতে কয়েকজনকে সহায়তা করেন। এক পর্যায়ে তার অভিজ্ঞতা হয়, ইতালির ফ্লোরেন্সে থাকা মান্নান সরদার নামের এক ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা না দিলে বিমানের ওয়েবসাইটে টিকিটের জন্য নিবন্ধন করা যাচ্ছে না। বিষয়টি তারা স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানালে পরে ওই পাঁচ হাজার টাকা ছাড়াই নিবন্ধন করা সম্ভব হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে টিকিট নিয়ে।

লাবণ্য জানান, বিমানের টিকিট কিনতে গিয়ে দেখা যায়- সেই মান্নান সরদারকে অতিরিক্ত টাকা না দিলে টিকিট মিলছে না। টিকিট পেতে বিমানের নির্ধারিত ভাড়া ৮৫ হাজার টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা মান্নান সরদারের দেওয়া বাংলাদেশের একটি নম্বরের বিকাশ অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হচ্ছে। একজন ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, নিবন্ধনের পর তিনি প্রথমে টিকিট কিনতে গিয়ে বিমানের ওয়েবসাইটে টিকিট পাননি। পরে মান্নান সরদারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে টিকিট কিনতে গেলে তার কাছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। পরে ৫ হাজার টাকা একটি বিকাশ অ্যাকাউন্টে, ২০ হাজার একটি অ্যাকাউন্টে এবং বিমানের জন্য ৮৫ হাজার টাকা পৃথকভাবে দেওয়ার পর তিনি টিকিট হাতে পান।

ইতালি প্রবাসী হাসান মাহমুদ সমকালকে জানান, মান্নান সরদার ফ্লোরেন্স বিএনপির উপদেষ্টা। তিনি ইতালিতে বিএনপি ঘরানার মানুষের মধ্যে প্রভাবশালী হিসেবেই পরিচিত। তিনি কয়েকদিন আগে প্রবাসীদের কাছে একটি ভয়েস মেসেজ পাঠান। সেই ভয়েস মেসেজে মান্নান সরদারকে বলতে শোনা যায়- তিনি এই বিমানের টিকিট সংক্রান্ত ব্যবসায় কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। অতএব তাকে তার লাভ বুঝে নিয়েই বিমানের টিকিট কাটার জন্য সহায়তা করতে হবে। তিনি তাকে বার বার ফোন না করে বাংলাদেশের একটি বিকাশ নম্বরে ফোন করে টিকিট কাটতে বলেন। ১৭ জুনের টিকিট ঘিরেও মান্নান সরদারের এই চক্র একইভাবে অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা নিয়ে টিকিট কাটতে বাধ্য করছে বলে জানান হাসান মাহমুদ।

একজন যাত্রীর পরিচয়ে সমকালের পক্ষ থেকে মান্নান সরদারকে ফোন করা হয়। দু'জন যাত্রীর জন্য টিকিট লাগবে জানালে তিনি জানান, ১৭ জুনের টিকিটের দায়িত্ব থেকে তিনি সরে গেছেন। অনেক কথা উঠছে, এ জন্য তিনি আর দায়িত্বে নেই। এছাড়া টিকিটও শেষ, এখন আর কিছু করারও নেই। এক পর্যায়ে টিকিট জরুরি জানিয়ে হেল্প চাইলে তিনি বাংলাদেশের 'মোল্লা' নামে একজনের নম্বর দেন। টিকিট সত্যিই পাওয়া যাবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমানের ওয়েবসাইট দেখেন। বিমানের ওয়েবসাইটে ঢাকা-লন্ডন একটি ফ্লাইটের শিডিউল দেখা যায়, যেখানে সকাল ১০টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে লন্ডনের স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে পৌঁছানের কথা বলা হয়েছে। টিকিটের জায়গায় লেখা আছে, 'নট অ্যাভেইলেবল'। মান্নান সরদার জানান, এই ফ্লাইটও ১২ জুনের ফ্লাইটের মতো লন্ডন হয়ে রোম আসবে, এ নিয়ে কোনো সংশয় বা সন্দেহ নেই। বিমানের ওয়েবসাইটে নোটিশের ক্ষেত্রে শুধু ১২ জুনের ফ্লাইটের কথা বলা আছে, ১৭ জুনেরটা নেই। এ তথ্যটি জানালে তিনি বলেন, শিডিউল তো আছে। নোটিশে চলে আসবে। আপনি টিকিট চাইলে বাংলাদেশে মোল্লার সঙ্গে তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করেন।

মোল্লাকে অনুসন্ধান : মান্নান সরদারের দেওয়া মোল্লার নম্বরে প্রথমে ফোন করলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে মান্নান ভাই নম্বর দিয়েছেন জানিয়ে মেসেজ করলে তিনি নিজেই ফোন করেন। তিনি জানান, তার পুরো নাম খাইরুল মোল্লা। টিকিটের খুব ক্রাইসিস। এরই মধ্যে ১৪১টি টিকিট বিক্রি হয়েছে। বাকি আরও প্রায় একশ' টিকিট কানফার্ম বুকিং আছে। বলা চলে, টিকিট নেই। তবে মান্নান ভাই যেহেতু বলেছেন, টিকিট দেওয়া যাবে। এ জন্য ইকোনমি ক্লাসে বিমানের টিকিট ৮৫ হাজার টাকা এবং বিজনেস ক্লাসে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪২০ টাকা পড়বে। এর বাইরে তার দেওয়া বিকাশ নম্বরে সিরিয়ালের জন্য ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। এই টাকা দিলে তারা বিমানের টিকিটের জন্য সিরিয়াল নম্বরে নাম তোলা হবে। পরে খাইরুল মোল্লা আরও একটি নম্বর দিয়ে সেখানে বিকাশ করতে বলেন।

সেই নম্বরে ফোন দিলে লিমন নামে আরও একজন ফোন ধরেন। তিনি জানান, ২০ হাজার টাকার সঙ্গে খরচ দিতে হবে এবং সেন্ড মানি করতে হবে। এই টাকা শুধু বিমানের টিকিটের জন্য সিরিয়াল। টিকিট কাটার সময় বিমানকে পৃথকভাবে টাকা দিতে হবে। আলাপের সময় লিমন আরও জানান, বিমানের এই ফ্লাইট ১৬ তারিখ রাতে। তাকে ১৭ জুন ওয়েবসাইটে থাকা শিডিউলের কথা জানালে তিনিও জানান, আসলে রাত ১২টার পর এ কারণে এটি ১৭ জুন দেখাচ্ছে।

ভুক্তভোগী অনেকেই জানান, তারা এভাবে মান্নান সরদার, খাইরুল মোল্লা হয়ে লিমনের বিকাশে টাকা দিয়ে টিকিটের জন্য সিরিয়াল নিয়েছেন। কারন ১২ জুনের টিকিটও এভাবেই কিনতে হয়েছে। যারা বিমানের এজেন্সির কাছে গেছেন তাদেরও বিকাশে ২০ হাজার টাকা পাঠিয়েই টিকিট কাটতে হয়েছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/200626340/