স্ট্রোকে আক্রান্ত এই নারীকে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে নিয়ে আসা হায় ঢাকা মেডিক্যালে। কিন্তু সেখানেও ঠাঁই মেলেনি সিট খালি না থাকার অজুহাতে। ছবি : মঞ্জুরুল করিম
৭ জুন ২০২০, রবিবার, ১:০৯

হাসপাতাল খালি তবু ঘুরে মরছে মুমূর্ষুরা

ভর্তি উপযোগী কভিড রোগীর তুলনায় হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা কয়েক গুণ বেশি

ধানমণ্ডির নাইমুর রহমান জ্বর, গলা ব্যথা ও কাশি উপসর্গ নিয়ে দুই দিন ঘুরেও ঢাকার সরকারি দুটি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। কারণ তখনো তাঁর টেস্টের রিপোর্ট হাতে পাননি। তিনি তাঁর এক আত্মীয়র মাধ্যমে যোগাযোগ করেন দুটি বড় প্রাইভেট হাসপাতালে। সেই দুটি থেকেও জানানো হয়, শয্যা খালি নেই। শেষ পর্যন্ত তিনি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করে বাসায়ই চিকিৎসা চালান। মহাখালীর বাসিন্দা আকমল হোসেন তাঁর স্ত্রীর করোনা উপসর্গ নিয়ে ছুটে যান মহাখালীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেখান থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ‘এখনো ওই হাসপাতাল পুরোপুরি প্রস্তুত নয়’ বলে।

এ ছাড়া কোনো কোনো হাসপাতালে ভর্তি কাউন্টারে প্রতিদিনই ‘সিট খালি নেই’ সিল মারা কাগজ দেখে হতাশায় ঘুরতে থাকে রোগী বা তাদের স্বজনরা। গণমাধ্যমেও প্রতিদিনই উঠে আসে এমন একের পর এক অভিযোগ।

প্রতিদিনই এমন কোনো না কোনো বঞ্চনার শিকার হচ্ছে কভিড বা নন-কভিড রোগীরা কোনো না কোনো হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালে এখন এই প্রবণতা আগের তুলনায় আরো বেড়ে গেছে। মাঝে কিছুদিন বেসরকারি হাসপাতালগুলো চিকিৎসা না দেওয়ার ক্ষেত্রে কভিড বা নন-কভিড সনদের অজুহাত দিলেও এখন তারা নতুন অজুহাত দেখাচ্ছে বেড খালি না থাকার। এ ক্ষেত্রে কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল সরকারের কাছ থেকে চুক্তির নামে টাকা আদায় করতে না পেরে করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকার পথ খুঁজছে। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালের সব কটি এখনো রোগীর সেবা দেওয়ার পর্যাপ্ত প্রস্তুত না হতে পারায় দেখাচ্ছে বিভিন্ন অজুহাত।

দেশের রোগতত্ত্ববিদরা বলছেন, দেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো নমুনায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে তার মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশের কোনো উপসর্গ নেই। আবার উপসর্গধারীদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশেরই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে সর্বশেষ হিসাব অনুসারে দেশে এ পর্যন্ত যে ৬৩ হাজার ২৬টি নমুনায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে মৃত্যু ও সুস্থ হওয়াদের বাদ দিলে এখন বাসা কিংবা হাসপাতালে আছে ৪৮ হাজার ৮৫৫ জন। রোগতত্ত্ববিদদের সূত্র ধরে বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজারের মতো আক্রান্ত মানুষের হাসপাতালে থাকার কথা, যাদের মধ্যে প্রতিদিন আরো ৬০০ থেকে ৭০০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি যায়। আবার প্রতি ২৪ ঘণ্টায় কয়েক দিন ধরে যে হারে শনাক্ত হচ্ছে তাদের ভেতর থেকে বড়জোর ৪০০ থেকে ৫০০ কভিড রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়। যেমন গতকাল বিকেল পর্যন্ত ঢাকা মহানগরীর সরকারি-বেসরকারি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে মোট কভিড রোগী ভর্তি ছিল মাত্র দুই হাজার ৭০০ জন। ঢাকার বাইরে সারা দেশের অন্য সব হাসপাতাল মিলে আরো প্রায় সমসংখ্যক কভিড রোগী ভর্তি রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বাইরে কভিড পজিটিভ রোগী ভর্তি হয়েছে মাত্র ১৬৫ জন। অন্যদিকে সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কভিড পজিটিভ রোগীদের জন্য মোট ৩৫ হাজার ১২৩টি বেড ডেডিকেটেড রাখা হয়েছে, যার ভেতর ৪৪৭টি আইসিইউ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা মহানগরীতেই বেড রয়েছে সাত হাজার ২৫০টি, যার মধ্যে আইসিইউ আছে ২১৮টি। এ ছাড়া ১০৬টি বেড নির্ধারিত রয়েছে কভিডে আক্রান্তদের ভেতর যাদের ডায়ালিসিস প্রয়োজন হয় তাদের জন্য। এসব পরিসংখ্যানের পর্যালোচনা অনুসারে এখন পর্যন্ত শুধু কভিড পজিটিভ হয়ে যারা হাসপাতালে যাচ্ছে তাদের তুলনায় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নির্ধারিত বেডসংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। ফলে প্রশ্ন জেগেছে, রোগীর তুলনায় অনেক বেশি বেড থাকা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হতে না পারা কিংবা বেডের অভাবের প্রশ্ন কেন বড় হয়ে উঠছে? মানুষই বা কেন হয়রান হচ্ছে ভর্তি হতে না পেরে?

এ প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভয় ধরে গেছে। কভিড পজিটিভ হোক না হোক, একটু উপসর্গ দেখা দিলেই তারা হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। এমনকি অনেকের করোনা পজিটিভ হলেও যাদের উপসর্গ নেই তারাও হাসপাতালে ভর্তি হতে যায়। আবার অনেকেই হয়তো বিশেষ দু-একটি পছন্দের হাসপাতালেই যেতে চায়। ফলে সেখানেই বেড খালি পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। অন্য হাসপাতালে বেড ফাঁকা থাকলেও সেখানে কেউ যেতে চায় না। এ ছাড়া তদিবরও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওই পরিচালক বলেন, ‘সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এখন আর কোনো ডেডিকেটেড বা বিশেষ ব্যবস্থা থাকছে না। এখন সবাই সব হাসপাতালেই যেতে পারবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি হাসপাতালেই আমরা দুই রকম ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিয়েছি। যাদের কভিড উপসর্গ থাকবে তাদের ওই হাসপাতালের কভিড ইউনিটে রাখতে হবে আর যারা নন-কভিড বা উপসর্গ না নিয়ে আসবে তাদের আলাদা ইউনিটে রাখা হবে। কোনো হাসপাতালই এখন আর কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না, সেটি সরকারি বা বেসরকারি যে হাসপাতালই হোক না কেন।’

করোনা মোকাবেলায় গঠিত সরকারের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্যসচিব ও আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই যেমন বলছি কভিড পজিটিভ হলেও যাদের উপসর্গ নেই বা খুবই মৃত্যু উপসর্গ আছে তাদের হাসপাতালে যাওয়ার দরকার নেই। বরং বাসায় থেকেই চিকিৎসকের পরামর্শমতো চিকিৎসা গ্রহণ করা ভালো। তবে অন্যদিকে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, কারো যদি করোনা পরীক্ষা করা না-ও হয়ে থাকে কিন্তু তার করোনার মতো বেশি উপসর্গ থাকে সে যে হাসপাতালেই যাবে তাকে সেখানে চিকিৎসা দিতে হবে, ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। ওই হাসপাতালেই আইসোলেশনে রেখে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্যই সব হাসপাতালে আমরা আইসোলেশন বেড বা কেবিনের কথা বলেছি।’

এই রোগতত্ত্ববিদ বলেন, ‘আমরা শুনছি অনেক ক্ষেত্রে কভিড সনদ বা নন-কভিড সনদ ছাড়া হাসপাতালগুলো রোগী ভর্তি করতে চায় না। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ জন্যই এখন আমরা সব হাসপাতালই সব রোগীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। সেই সঙ্গে কোনো হাসপাতাল যাতে রোগী ফিরিয়ে না দেয় সেটিও নিশ্চিত করতে মনিটরিং বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছি।’ তিনি বলেন, একটি বিষয় সবার মাথায় রাখা উচিত যে এখন কিন্তু শুধু করোনাই নয়, অন্য ইনফ্লুয়েঞ্জারও সময়। তাই জ্বর উপসর্গ দেখেই রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হলে সেটি রীতিমতো অন্যায় হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সারা দেশে আমাদের ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতালে প্রায় ৬০ হাজার বেড ও পাঁচ হাজার ৫০টি বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় এক লাখ বেড রয়েছে সব পর্যায়ের হাসপাতাল মিলে। এখন সব হাসপাতালই সব রোগীর চিকিৎসা দেবে। ফলে বিশৃঙ্খলা থাকার কথা নয়।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2020/06/07/919984