৫ জুন ২০২০, শুক্রবার, ৮:৩৫

লোভের শিকার যাত্রী : স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই

৬০% ভাড়া বাড়লেও গণপরিবহনে নেয়া হচ্ছে দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া

রাজধানীতে বাসে পা দিলেই ভাড়া ১০ টাকা

 

করোনা সংক্রমণের মধ্যেই বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গণপরিবহন চালু করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যের পরিবহন মন্ত্রী শভেন্দু অধিকারী বাস মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে করোনাকালে বাসভাড়া কিছু বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সাফ কথা বাসভাড়া এক পয়সাও বাড়বে না। বাধ্য হয়েই বাস মালিকরা গণপরিবহন রাস্তায় নামাতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি কথায় কথায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ টানেন। কিন্তু পরিবহন ভাড়া নিয়ে সেই উদাহরণ উচ্চারণ করছেন না। বাংলাদেশে সরকার জনগণের সুবিধার কথা বিবেচনা করে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু চালুর আগেই পরিবহন মালিকরা কিছু আমলাকে খুশি করে বাসভাড়া একশ’ ভাগ বৃদ্ধির দাবি তোলে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসিতে এ নিয়ে এক ঘণ্টার বৈঠকে শতকরা ৮০ ভাগ বাসভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়। এ খবর প্রচারের পর জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার খবর মিডিয়ার প্রচার হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ হতে থাকে। পরের দিন সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রী-ব্যাক্তি পরিবহন মালিক (মূলত এক বছর আগেও এরা সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন) সেটা কমিয়ে শতকরা ৬০ ভাগ ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে পরিবহন শ্রমিক, যাত্রীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়। স্যানিটাইজার, চালক-শ্রমিকের মাস্ক, গøাভসসহ বাকি সুবিধাগুলো নেই। কয়েকজন মালিক দাবি করেছেন, তারা সব সরঞ্জাম দিয়েছেন। তবে উভয় বাসের চালক বললেন, মালিকের কাছ থেকে তারা সুরক্ষা সরঞ্জাম পাননি। গণপরিবহনে স্বাস্থ্যসেবা মানেই যেন ‘লোক দেখানো’ পানি ছিঁটানো।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, পেট্রোলের দাম আন্তর্জাতিকভাবে খুবই কমেছে। এক্ষেত্রে সরকার দেশে পেট্রোলের দাম কমিয়ে যারা বাস মালিক আছেন তাদের বলতে পারতেন এক টাকাও ভাড়া বাড়বে না। সরকার যেটা করেছে বাস মালিকদের প্রণোদনা গরিব লোকের পকেট থেকে নিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের প্রফিট অক্ষুন্ন রেখেছে। সরকারের উচিৎ ছিল বাস মালিকদের বলা প্রতি দুই সিটের একটি খালি থাকবে। বিষয়টি গরিব মানুষদের প্রতি খুবই বড় অন্যায় এবং এর জন্য সরকার দায়ী। লেখক ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, পরিস্থিতি আরো পর্যালোচনা করে কিছুদিন দেরি করে গণপরিবহন চলাচল শুরু করা যেতো। এখন যদি গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী না তোলা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা পালন না করা হয় তাহলে খুব বড় রকমের বিপদের সম্ভাবনা আছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধিঃনস্ত বিআরটিসি হিসেব অনুযায়ী প্রতি কিলোমিটার বাসভাড়া এক টাকা ৭০ পয়সা, আর মিনিবাসে প্রতিকিলোমিটার ভাড়া এক টাকা ৬০ পয়সা। বাসের ভাড়া সর্বনি¤œ ৭ টাকা ও মিনি বাসের সর্বনি¤œ ভাড়া ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় প্রতি কিলোমিটার বাসের ভাড়া ৫ টাকা থেকে ৭ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এমনকি ১০ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেয়া হচ্ছে না। বাসে পা দিলেই ১০ টাকা ভাড়া গুণতে হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ রোধে দীর্ঘ দুই মাস বন্ধ থাকার পর গত সোমবার রাজধানীতে যাত্রীবাহী বাস চলাচল শুরু হয়েছে। কিছু কিছু বাসে সরকার নির্ধারিত বর্ধিত ভাড়ায় আদায় হলেও অধিকাংশ বাসে দ্বিগুণ-আড়াইগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। আবার প্রায় সব বাস অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাকী সিট ফাকা রাখলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। বাসে স্বাস্থ্য বিধি রক্ষা যেন বোতলের পানিতে সামান্য ডেটল দিয়ে স্প্রে করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গতকাল গুলিস্তানে দেখা গেল অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাসের আসন ফাঁকা রাখার নির্দেশনা পালন করা হচ্ছে। তবে কিছু বাসে দাঁড়িয়েও যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়। সামাজিক দ‚রত্বের কথা বলা হলেও রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মোড়ে যাত্রীদের গা ঘেঁষে লাইনে দাঁড়িয়ে বাসে উঠতে দেখা গেল। বাসে স্যানিটাইজার রাখা, যত্রতত্র যাত্রী না তোলা, যাত্রী ওঠানামার সময় তিন ফুট দ‚রত্ব রক্ষা, প্রতি যাত্রার আগে বাস জীবাণুমুক্ত করার এসব শর্তের কিছুই মানা হচ্ছে না।

কাজলা থেকে মতিঝিল সর্বোচ্চ ৫ কিলোমিটার। ওভার ব্রিজ চালু হওয়ার পর হিমালয় বাসে ভাড়া নেয়া হতো ১০ টাকা। আর এক কিলোমিটার দূরের শনিরআখড়া থেকে নেয়া হতো ১৫ টাকা। সরকারের বেঁধে দেয়া ভাড়ায় শনিরআখড়া থেকে মতিঝিল ৬ কিলোমিটার রাস্তার ভাড়া সর্বোচ্চ হওয়ার কথা ১০ টাকা। কিন্তু এখন ৩০ টাকার কম কোনো ভাড়া নেয়া হচ্ছে না। কাজলা থেকে আগের ১০ টাকা ভাড়ার শতকরা ৬০ ভাগ বাড়লে ১৬ টাকা নেয়ার কথা। কিন্তু নেয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। আবার গুলিস্তান থেকে মতিঝিল নেয়া হচ্ছে ১০ টাকা। অন্যান্য রুটের বাসগুলোর ভাড়া নেয়ার চিত্র প্রায় অভিন্ন। করোনায় দুই মাস বন্ধ থাকায় বাস মালিকরা লোকসান পোষাতে ভাড়া ৬০ ভাগ বাড়লেও প্রথম দিন থেকেই ভাড়া দ্বিগুণ-আড়াইণের বেশি নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সরেজমিন হিমালয় বাসে দেখা গেল কয়েকটি সিট ফাকা রেখেই বাস যাতায়াত করছে। তবে ভাড়া দ্বিগুন-আড়াইগুণ বেশি নেয়া হচ্ছে। সেন্ট্রাল পরিবহনের বাসে ভ্রমণ করে দেখা গেল মূল সিট ফাঁকা রাখতে ১০টি বাড়তি আসন বসানো হয়েছে। ৩২ সিটের বাসকে অবৈধভাবে ৪২ সিটে রূপান্তর করা হয়েছে। করোনাকালে বাসটিতে সর্বোচ্চ ১৬ জন যাত্রী পরিবহনের অনুমতি রয়েছে। অবৈধভাবে যোগ করা বাড়তি আসন হিসাবে ধরলে ২১ জন যাত্রী পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু নেয়া হচ্ছে দ্বিগুণ ভাড়া।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে নতুন বাজার থেকে সাভার রুটের ‘অগ্রগামী পরিবহনে’। গাবতলী সেতু থেকে হেমায়েতপুরের ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। এ পথে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১৪ টাকা। করোনাকালে তা ২২ টাকা হওয়ার কথা। যাত্রীরা বলছেন, আগে ভাড়া ছিল ১০ টাকা।
আগে মিরপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটের ভাড়া ছিল ৬০ টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ৯৫ টাকা। পথের স্টপেজে উঠলে ভাড়া নেয়া হচ্ছে আরো বেশি।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ি, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, কল্যাণপুর, শ্যামলী, তেজগাঁও, প্রেসক্লাব, শাহবাগ, পল্টন, মতিঝিল ঘুরে দেখা গেল গণপরিবহনের প্রায় অভিন্ন দৃশ্য। হিমালয়, অনাবিল, ফাল্গুনি, স্বদেশ, পল্লবী, বিকল্প, সালসাবিল, আকিক, উইনারসহ বিভিন্ন গণপরিবনে দেখা যায় গাদাগাদি করে বসে যাচ্ছেন যাত্রীরা। নেই শারীরিক দ‚রত্ব। যাত্রীদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে না। বাসের চালকের সহকারী দরজায় দাঁড়িয়ে গায়ে হাত দিয়ে যাত্রী তুলছে। ফলে করোনা সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা বেড়েই চলছে। বাড়তি ভাড়া নিয়ে আসন ফাঁকা না রেখে যাত্রী বহন করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।

ভাড়া বেশি নিলেও অধিকাংশ বাসই স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। সম্প্রতি এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ ভিজিল্যান্স টিম, মোবাইল কোর্টসহ টার্মিনাল কর্তৃপক্ষকে বাসভাড়া ও স্বাস্থ্যবিধির বিষয়াদি তদারকি করবে। কিন্তু গণপরিবহনে ভাড়া বেশি নেয়া বা স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা পর্যবেক্ষণে বিআরটিএ বা সরকারের কোনো সংস্থার তদারকি দেখা যায়নি।

https://www.dailyinqilab.com/article/296681/