খুলনার কয়রায় মঙ্গলবার আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে টিন বিতরণ করেন কোস্টগার্ডের সদস্যরা - সমকাল
৪ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৮:১৬

শেষের পাতা

ঘূর্ণিঝড়ে বিপদ বাড়ছেই

জলবায়ু পরিবর্তন

গত ছয় দশকে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে দেশের জলবায়ু পরিস্থিতিতে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধির জেরে বাংলাদেশ উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। এমনকি সরকারের প্রস্তুতির নিরিখে নভেম্বর ও এপ্রিল মাসকে ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ধরে নেওয়া হলেও বিস্ময়করভাবে মে মাসেই বাড়ছে বিপদ।

গবেষণা বলছে, গত ছয় দশকে বঙ্গোপসাগর উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে চারগুণ। সাম্প্রতিক সময়ে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ের গতি-প্রকৃতি এবং ছোবল মারার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ে যোগ হয়েছে নতুন নতুন মাত্রা। প্রাণহানির ঘটনা কমলেও বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি। সমুদ্রের তাপমাত্রা, চাপ ও বায়ুপ্রবাহ স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করায় ঝড়ের গতি-প্রকৃতি বছর বছর বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠবে বলেই আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃতদেহের সংখ্যা দিয়ে কখনও ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা নিরূপণ করা যায় না। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণের কারণে প্রাণহানি কমলেও সম্পদের ক্ষতি কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সমস্যা হলেও এর ছোবল ভয়াবহভাবে পড়ছে বাংলাদেশের উপকূলে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৭৯৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২২৩ বছরে বঙ্গোপসাগর উপকূলে আঘাত হেনেছে ৭৮টি ঘূর্ণিঝড়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ১৬৩ বছরে আঘাত হেনেছে ৩০টি। শেষ ৬০ বছরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ৪৮টি। এর মধ্যে সর্বশেষ এক বছরেই উপকূলে আছড়ে পড়ল তিনটি ঘূর্ণিঝড়। অন্যদিকে, ছয় দশকে ৩৬টি ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে। ঐতিহাসিক ঘূর্ণিঝড়গুলো বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৬০ সালের পর ৩৬টি ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে ১৫টি এসেছে মে মাসে। ১০টি আঘাত হেনেছে নভেম্বরে। মে মাসে ঘূর্ণিঝড় প্রবণতা বৃদ্ধির তথ্য দেখা যায় সর্বশেষ এক যুগের পরিসংখ্যানেও। ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আঘাত হানা নয়টি ঘূর্ণিঝড়ের সাতটিই মে মাসে। বাকি দুটি জুলাই এবং নভেম্বর মাসে।

উপকূলে সর্বশেষ গত ২০ মে সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন 'আম্পান'। এর মূল প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের ওপর পড়লেও বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ ২৬টি জেলায় পড়েছে ক্ষত। এতে অন্তত ২১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। সরকারের প্রাথমিক হিসাবে, আম্পানের আঘাতে আনুমানিক ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ফসল নষ্ট হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমির।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, আগে এক সময় দুই-তিন বছর পরপর ঘূর্ণিঝড় হতো। এখন প্রতিবছরই হচ্ছে। বছরে একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলেও পড়তে হচ্ছে। ফলে দুর্যোগ প্রস্তুতির বিষয়ে কিছু নতুন চিন্তাভাবনা করতে হবে। বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ভালো করলেও মাঠপর্যায়ে এর শতভাগ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।

গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা সমকালকে বলেন, মৃতদেহ হিসাব করে একটি ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্র নির্ধারণ করা যায় না। ঘূর্ণিঝড় কেন বাড়ছে, এর প্রভাবে কোন কোন জায়গায় ক্ষতি বেশি হতে পারে, সে অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলে সম্পদের ক্ষতিও প্রশমন করা সম্ভব। সম্প্রতি বড় বড় ঘূর্ণিঝড় হলেও মাঠপর্যায়ে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনেক ঘাটতি দেখা যায়।

এদিকে, মে মাসে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা ১ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধির তথ্য দিয়েছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা। এ সংস্থাটির মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা শিল্পযুগের আগের তুলনায় গড়ে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ীও বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড় বেড়েছে, তা বলার সময় এখনই আসেনি বলে জানান আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন। তিনি সমকালকে বলেন, এটি ঠিক যে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গোপসাগর উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা একটু বেড়েছে। তবে তা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কি-না, অল্প কয়েক বছরের পরিস্থিতি দিয়ে তা হিসাব করা সম্ভব নয়।

আরিফ হোসেনের পর্যবেক্ষণ, এপ্রিল থেকে মে মাসের পুরোটা এবং অক্টোবরের শেষ পক্ষ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ঘূর্ণিঝড় নিয়মিত হচ্ছে। এই সময়টিকে আমলে নিয়ে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান উপকূল থেকে ৭০০-৮০০ কিলোমিটার দূরে থাকতেই সুপার সাইক্লোনে রূপ নিয়েছিল। ফলে আঘাত হানার সময় এর গতি কমে যায়। অন্যথায় ভয়াবহ পরিণতি দেখতে হতো।

ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি দেশে কালবৈশাখী ঝড়ের সংখ্যাও বাড়ছে। গত ২৫ মে রাতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তীব্র গতির কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। ওই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৮২ কিলোমিটার। তবে বেশি গতির ঝড় কম সময় বহমান থাকায় ক্ষয়ক্ষতি সেভাবে হয়নি।

https://samakal.com/todays-print-edition/tp-last-page/article/200640987