২ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ৮:১১

গুরুতর করোনা রোগীর চিকিৎসা

অনলাইনে অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার হিড়িক

চলছে আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি, অনেকে নিচ্ছেন ভাড়ায় * ঘরে রাখায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি ছাড়াও আছে ব্যবহার বিধি না জানার বিপদ

করোনা আতঙ্কে অনলাইনে অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার রীতিমতো হিড়িক পড়ে গেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা না মেলায় বাড়িতে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীরা ব্যাপকভাবে অক্সিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন।

প্রচুর চাহিদার কারণে হোম সার্ভিসে অক্সিজেন ডেলিভারির বেশকিছু প্রতিষ্ঠানও রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে। আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হচ্ছে একেকটি সিলিন্ডার। অনেকে কিনতে না পেরে স্বজন বাঁচাতে তড়িঘড়ি ভাড়ায় নিচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার।

সিলিন্ডারের পাশাপাশি পোর্টেবল অক্সিজেন ক্যান, পোর্টেবল ভেন্টিলেটর ও দেহের অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের জন্য পালস অক্সিমিটার নামের ছোট একটি যন্ত্র অনলাইনে বিক্রির শীর্ষে রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়াই অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারে প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসাসংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীতে সক্রিয় অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম ডেলিভারির অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাদের প্রায় সবাই বলছেন, এপ্রিল মাস থেকে তাদের কাছে সিলিন্ডারের বাড়তি চাহিদা আসতে থাকে।

মে মাসের মাঝামাঝি থেকে চাহিদা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন ডেলিভারি দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্টক ফুরিয়ে যাওয়ায় অনেকে হোম ডেলিভারি সেবা বন্ধ রেখেছেন। কেউ কেউ একেকটি সিলিন্ডার বিক্রি করছেন বাজার মূল্যের চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি দামে।

চিকিৎসাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো কোথা থেকে আমদানি করা হচ্ছে বা এগুলো মেয়াদ উত্তীর্ণ কিনা তা যাচাই ছাড়াই বাজারজাত করা দণ্ডনীয় অপরাধ। চাহিদার কারণে খোলাবাজারে এভাবে ঢালাও অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করা কোনোভাবেই উচিত নয়। তাছাড়া বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার ফলে অগ্নিকাণ্ডের বড় ধরনের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

এদিকে কোভিড হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সংকটের কথা বলছেন করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রোগীরা। তীব্র শ্বাসকস্টের সময় হাইফ্লো অক্সিজেন দরকার হলেও বেশির ভাগ সময় হাসপাতালে তা মিলছে না।

একসঙ্গে একাধিক রোগীর প্রয়োজন হওয়ায় কোভিড হাসপাতালগুলোতে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হচ্ছে রোগীদের। গুরুতর অসুস্থ রোগীরা বিছানা ছেড়ে উঠতে না পারলে নির্মম পরিণতির স্বীকার হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতির কারণেই অক্সিজেন সিলিন্ডারের হোম সার্ভিস চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

কিছুটা সুস্থ হয়ে সদ্য হাসপাতাল ফেরত এক সরকারি কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কোভিড হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা এতটাই খারাপ যে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। একটি মাত্র সিলিন্ডার ওয়ার্ডের কোনো এক জায়গায় রাখা থাকে। শ্বাসকষ্টে থাকা রোগীদের পালা করে সেখানে গিয়ে অক্সিজেন মাস্ক পরতে হয়। ভিড় লেগে যাওয়ায় একজন বেশিক্ষণ নিতে পারেন না।

আবার সিলিন্ডার ফুরিয়ে গেলে নতুন সিলিন্ডার আসতেও দেরি হয় অনেক। দিনের বেশির ভাগ সময় ডাক্তার বা নার্সের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। হাসপাতালের এমন করুণ অভিজ্ঞতার কারণে করোনা আক্রান্ত অনেকেই বাড়িতেই চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাদের কেউ কেউ আগেই অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রাখছেন বাসায়। কারণ সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে গিয়েও লাভ হচ্ছে না।

পি-৪ হেলথ নামের অনলাইনভিত্তিক অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম সার্ভিসের এক প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইটে নানা ব্র্যান্ডের অক্সিজেন সিলিন্ডারের ছবিসহ মূল্য তালিকা দিয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ১৫শ’ লিটার সিলিন্ডারের দাম ১৩ হাজার ৮শ’ টাকা এবং ২ হাজার লিটারের দাম ১৬ হাজার ৭শ’ টাকা। এর সঙ্গে অক্সিজেন মাস্কের দাম ও হোম ডেলিভারি চার্জ নেয়া হচ্ছে আরও প্রায় ৬শ’ টাকা।

যোগাযোগ করা হলে পি-৪ ফেসবুক পেইজের স্বত্বাধিকারী মেসবাহ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ যত বাড়ছে সিলিন্ডারের চাহিদাও তত বাড়ছে। কিন্তু বাজারে সিলিন্ডারের সংকট। এ কারণে আমাদের ডেলিভারি বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ এখন প্রতিদিন সিলিন্ডার চেয়ে এত বেশি ফোন আসছে যে, আমাদের হোম ডেলিভারির জন্য নির্ধারিত ফোনটি বন্ধ রাখতে হয়। অনেকেই ফোন করে কান্নাকাটি করেন।

বলেন, ‘দয়া করে জীবন বাঁচান। কিন্তু আমরা দিতে পারছি না। তাছাড়া এ ব্যবসায় অনেকেই প্রতারণা করছেন। সিলিন্ডারের বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তাছাড়া অক্সিজেন ব্যবহারের সময় পরিমাপের জন্য ব্যবহৃত ফলো মিটারও পাওয়া যাচ্ছে না। দেড় হাজার টাকার ফলো মিটার এখন বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়।’

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হোম ডেলিভারির জন্য রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দোকান ভাড়া নিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার অস্থায়ী গোডাউনও তৈরি হয়েছে। নদ্দা ও বাড্ডা এলাকায় এ ধরনের গোডাউনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। নদ্দা এলাকা থেকে লিনডে বাংলাদেশ ও ইসলাম অক্সিজেনের সিলিন্ডার সরবরাহ করছেন জিয়া নামের একজন ব্যক্তি। অনলাইনে মোবাইল নম্বর ও সিলিন্ডারের মূল্যসহ মাত্র ২ ঘণ্টার মধ্যে হোম ডেলিভারি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে তার ফেসবুক পেইজে। বুধবার যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির আগে প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৫-৬টি সিলিন্ডার হোম ডেলিভারি হতো। কিন্তু বর্তমানে চাহিদা অনেক। পাইকারি মার্কেটেও সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও প্রতি মাসে ৩০-৪০টির বেশি সিলিন্ডার ডেলিভারি দিতে পারছেন না তারা।

দেখা যায়, অনলাইনে হোম ডেলিভারির জন্য সিলিন্ডারপ্রতি দাম রাখা হচ্ছে ১৭ হাজার ৫শ’ টাকা থেকে ২৫ হাজার ৫শ’। এর সঙ্গে পালস অক্সিমিটার ৫ হাজার টাকাসহ মোট ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। আবার মাসিক ভাড়ায়ও মিলছে সিলিন্ডার। সেক্ষেত্রে ভাড়া ১১ থেকে ১৫ হাজার টাকা। খালি সিলিন্ডার রিফিলের খরচ ১ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। শপ বিডি ডটকম, হোম সার্ভিস, ইসরাত অক্সিজেন হোম সার্ভিস, অক্সিজেন সাপ্লাই ও সালাউদ্দিন অক্সিজেন সাপ্লাইসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে অর্ডার নিচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশাপাশি অনলাইনে মাস্ক, গ্লাভস ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ কোভিড সুরক্ষা পণ্য বিক্রিতে রীতিমতো ধুম পড়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, দেহে কতটুকু অক্সিজেন দরকার হবে তার জন্য রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। সাধারণ দু’ভাবে অক্সিজেন দেয়া হয়- একটি হচ্ছে মাস্কের সাহায্যে। অপরটি ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে। দুটি পদ্ধতিতেই চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। কারণ দেহের অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের পরই প্রতি মিনিটে কতটুকু অক্সিজেন প্রবাহ প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা হয়। শ্বাসকষ্ট হলেই অক্সিজেন নেয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ পাল পিটিশনসহ অনেক কারণেই শ্বাসকস্ট দেখা দিতে পারে। ত

বে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ শতাংশের নিচে নেমে গেলে মিনিটে ২ লিটার করে অক্সিজেন দিতে হয়। এতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে প্রবাহ দ্বিগুণ করতে হয়। তবে প্রয়োজন ছাড়াই উচ্চমাত্রার অক্সিজেন নেয়া হলে স্বাস্থঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি। এক্ষেত্রে শিশুদের রেটিনায় চাপ পড়ে চিরতরে অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সেল ড্যামেজ হতে পারে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/312206/