২ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ৮:১০

সারা দিন বৃষ্টিতে ভিজল আর রোদে শুকাল সালেহ আহম্মদের লাশ

কাছে আসেনি পরিবারের কেউ, এগিয়ে আসেনি গ্রামবাসী

ঘরের সামনে ছোট্ট একটি চৌকি। তার ওপর পড়ে আছে হতভাগ্য সালেহ আহম্মদের (৬০) লাশ। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজল, রোদে শুকাল। করোনার উপসর্গে তার মৃত্যু। তাই ভয়ে কেউ কাছে আসেনি। না পরিবারের কেউ, না গ্রামবাসী। দাফনেরও উদ্যোগ নেয়নি কেউ।

এমন মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৫ নম্বর ওচমানপুর ইউনিয়নে। ওই ইউনিয়নের সাহেবপুর গ্রামের কালা বক্সের বাড়ির সালেহ আহম্মদ মারা যান চট্টগ্রাম শহরে। লাশ গ্রামে নিয়ে আসেন তার ভাই নুর আহম্মদ। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা, আত্মীয়স্বজন, গ্রামবাসী কেউ আর এগিয়ে আসেনি। শেষ পর্যন্ত এগিয়ে এলো ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’ নামে একটি সংগঠন। করোনা পরিস্থিতিতে গঠিত এই সংগঠনের সদস্যরা সালেহ আহম্মদের লাশ কাফন ক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

জানা গেছে, মিরসরাই উপজেলার ৫ নম্বর ওচমানপুর ইউনিয়নের সাহেবপুর গ্রামের কালা মিয়ার বাড়ির সালেহ আহম্মদ দীর্ঘ দিন কুয়েতে থাকার পর দুই বছর আগে দেশে এসে চট্টগ্রাম শহরে সপরিবারে বসবাস করেন। ক’দিন ধরে তার জ্বর ও কাশি ছিল। এর মধ্যে তার ভাইয়ের ছেলের এক পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। সবাই ওই নবজাতককে নিয়ে হাসপাতালে ব্যস্ত থাকে। তাই বাসার মধ্যে একাই ছিলেন তিনি। গত মঙ্গলবার রাত ৩টায় তিনি মারা যান। ভাইয়ের মৃত্যুর খবরে ছুটে আসেন তার আরেক ভাই নুর আহম্মদ। কিন্তু স্ত্রী, ভাতিজারা কেউ লাশের সাথে গ্রামের বাড়ি যেতে রাজি হননি। গতকাল বুধবার ভোরে অ্যাম্বুলেন্সে ভাইয়ের লাশ নিয়ে একাই শহর থেকে ফিরেন নুর আহম্মদ। গ্রামে আসার পর বড় বিপত্তি। লাশের সাথে পরিবারের কোনো সদস্য না আসায় বাড়ির কোনো লোকও এগিয়ে আসছে না। গ্রামবাসী তো দূরের কথা, উল্টো গ্রামে লাশ দাফন করতে বাধা দিচ্ছেন তারা। নুর আহম্মদ পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেন; কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। এভাবে কেটে যায় সারাটা দিন। এর মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজেছে সালেহ আহম্মদের নিথর দেহ! পরে বিকেলে খবর পেয়ে ছুটে যান ‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’ নামের সংগঠনের সদস্যরা। লাশের গোসল, কাফন ও দাফন সম্পন্ন করেন তারা।

শেষ বিদায়ের বন্ধু সংগঠনের ওচমানপুরের টিম লিডার সদস্য মাওলানা মিজানুর রহমান বলেন, আমরা যাওয়ার পর দেখি লাশের উপর ময়লা, মুরগির বিষ্ঠা পড়ে রয়েছে। বাড়ির লোকদের কাছে একটি গামছা চেয়েছিলাম; কিন্তু কেউ দিতে রাজি হয়নি। মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে!

সালেহ আহম্মদের ভাই নুর আহম্মদ বলেন, আমার ভাইয়ের কোনো সন্তান নেই। সারা জীবন রোজগার করে ভাতিজাদের ভরণ-পোষণ করেছেন। কিন্তু মারা যাওয়ার পর স্ত্রী, ভাতিজারা কেউ কাছে আসেনি। তিনি আরো বলেন, আমার ভাই মারা যাওয়ার পরপরই আমি এলাকায় ফোন করে খবর দিই এবং কবর তৈরি করতে বলি। তারা আমাকে আসতে অনুমতি দেয়। কিন্তু বাড়িতে লাশ নিয়ে আসার পর কেউ আর এগিয়ে আসেনি। সারা দিন পর একটি সংগঠনের লোকজন এসে কাফন দাফনের কাজ সম্পন্ন করে দিয়ে যায়।

এই বিষয়ে ওচমানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মফিজুল হক জানান, বুধবার ভোরে একটি অ্যাম্বুলেন্সে সালেহ আহম্মদের লাশ বাড়ি নিয়ে আসেন তার ভাই। লাশটি রেখে দ্রুত চলে যায় অ্যাম্বুলেন্সটি। এ ছাড়া লাশের সাথে স্ত্রী সন্তান কেউ না আসায় এলাকাবাসী আতঙ্কিত হয়ে যায়।

‘শেষ বিদায়ের বন্ধু’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সমন্বয়কারী সাংবাদিক নুরুল আলম জানান, ওচমানপুর ইউনিয়নের সাহেবপুর গ্রামের সালেহ আহম্মদের লাশ পড়ে থাকার খবর পাই। এরপর আমাদের সংগঠনের ওচমানপুর ইউনিয়নের সদস্যরা দ্রুত গিয়ে লাশের গোসল, কাফন দাফন সম্পন্ন করে দেন। তিনি আরো জানান, করোনা মহামারীর সময়েই আমরা এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছি। সংগঠনটির কার্যক্রমের মূলে রয়েছে, কোনো লোক মারা গেলে তার কাফন দাফন সম্পন্ন করা। এ ক্ষেত্রে তাদের খবর দিলেই সংগঠনটির সদস্যরা উপস্থিত হয়ে নিজ খরচায় সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/505771/