২ জুন ২০২০, মঙ্গলবার, ৮:০৪

প্রকল্প শুরু হতেই ৩ বছর ব্যয় বৃদ্ধি ৩৯৫ কোটি টাকা

কচ্ছপ গতিতে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্প অনুমোদনের পর সেটির বাস্তবায়নে ঘটছে গড়িমসি। সংশ্লিষ্ট সংস্থার সাথে সমন্বয়হীনতার কারণেই প্রকল্পগুলো বিভিন্ন জটিলতায় পড়ছে। ঢাকা ওয়াসার সাড়ে চার বছরে সমাপ্তযোগ্য একটি প্রকল্প শুরু করতেই লেগেছে তিন বছর। নির্ধারিত ও অনুমোদিত মেয়াদে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৪৯.৭৫ শতাংশ। ওয়াসা বলছে, প্রকল্প এলাকাতে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) দু’টি টাওয়ার সরাতেই এক বছর লেগেছে। ২০১৫ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেও বিদ্যুতের আটটি টাওয়ার স্থানান্তর করতে ২০১৮ সালের জুন পার হয়েছে। এখন প্রকল্পের ব্যয় ৩৯৫ কোটি টাকা বাড়ছে। পাশাপাশি সময় বাড়ানো হচ্ছে আরো তিন বছর। পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প শক্তি বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

ঢাকা ওয়াসার প্রস্তাবনা ও পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ এলাকাই পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার বাইরে। যে ২০ শতাংশ এলাকায় সুয়ারেজ ব্যবস্থা রয়েছে তার পয়ঃবর্জ্য কোনো শোধন ছাড়াই বেগুনবাড়ি, রামপুরা ও নড়াই খালের মাধ্যমে বালু নদী হয়ে চলে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যায়। বালু ও শীতলক্ষ্যার মিলনস্থলের মাত্র ৫০০ মিটার ভাটিতেই সারুলিয়ায় সায়েদাবাদ পানি শোধনাগারের ইনটেক পয়েন্ট অবস্থিত। এ পয়েন্ট থেকেই শোধনাগারটি র’ওয়াটার সংগ্রহ করছে। নদীর পরিষ্কার পানি এ প্লান্টে সরবরাহের কথা থাকলেও বর্জ্যমিশ্রিত এই র’ওয়াটার শোধন করতে অক্ষম ট্রিটমেন্ট প্লান্টটি। ফলে খুব সহজেই প্রায় অশোধিত পানি চলে যাচ্ছে ঢাকা শহরে। এই জটিলতার কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ দেখা যায়। আর এই সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যেই সরকার ২০১৫ সালের আগস্টে ৩ হাজার ৩১৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে দাশেরকান্দিতে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন পয়ঃশোধনাগার স্থাপনের প্রকল্প অনুমোদন দেয়। প্রকল্পে এক্সিম ব্যাংক অব চায়না থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করে দুই হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকারের। এখন এই প্রকল্পের ব্যয় ৩৯৫ কোটি টাকা বেড়ে তিন হাজার ৭১২ কোটি ৫৪
লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে। আর সমাপ্ত করতে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়েছে। আজ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় এই সংশোধন অনুমোদনের জন্য প্রকল্প উপস্থাপন করা হচ্ছে।

জানা গেছে, অপরিকল্পিতভাবেই ঢাকার পয়ঃবর্জ্য নিষ্কাশিত হচ্ছে। সুয়ারেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ায় বৃষ্টি হলে পয়ঃবর্জ্য একাকার হয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ওয়াসা সম্প্রতি একটি সুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেছে। তাতে ১১টি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। এখন শুধু খিলগাঁওয়ের দাশেরকান্দি এলাকায় তিন হাজার ৩১৭ কোটি টাকায় পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ চলমান। ২০১৫ সালের আগস্টে এর অনুমোদন দেয়া হয়। একই বছর ৩০ আগস্ট প্রকল্পের ঠিকাদার হাইড্রো চায়না করপোরেশনের সাথে ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর এক বছর দুই মাস পর ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাথে এক্সিম ব্যাংক অব চায়নার ঋণ চুক্তি হয়, যা ২০১৭ সালের ৮ মে থেকে কার্যকর হয়। প্রকল্পের আওতায় এক্সেস রোডসহ মোট ৬২ দশমিক ৬১ একর জমি অধিগ্রহণ করতে আরো এক বছর সময় লাগে। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। অধিগ্রহণের দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হয়। এ ছাড়া অধিগ্রহণকৃত জায়গায় পিজিসিবির মালিকানাধীন হরিপুর-রামপুরা এবং ঘোড়াশাল-রামপুরা ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইনের দু’টি টাওয়ার ছিল। টাওয়ার দু’টি স্থানান্তরের জন্য পিজিসিবির আরো আটটি টাওয়ার স্থানান্তর করতে হয়। যা করতে এক বছর সময় লেগেছে। ফলে মূল কাজ শুরু করা হয় ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে।

ঢাকা ওয়াসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ওয়াসার কদমতলী থানাধীন পাগলায় পয়ঃশোধনাগারটির মাধ্যমে ঢাকা শহরের মাত্র ২০ শতাংশ জনগণ পয়ঃসুবিধা পাচ্ছে। বাকি মহানগরীর উত্তর-পূর্বাংশের গুলশান, বনানী, বারিধারা, বসুন্ধরা, মহাখালী, বারিধারা ডিওএইচএস, তেজগাঁও, মগবাজার, ইস্কাটন, নিকেতন, ধানমন্ডি (আংশিক), কলাবাগান, আফতাবনগর, বাড্ডা, হাতিরঝিলসহ ৮০ শতাংশ এলাকার জন্য কোনো পয়ঃশোধনাগার নেই। ফলে কোনোরকম শোধন ছাড়াই শীতলক্ষ্যা নদীতে তরল বর্জ্য নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এতে নদীর পানি দূষিত হওয়ার সাথে সাথে শোধনাগারের ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর মাধ্যমে শহরে ফেরত পাঠানো পানিও দূষণমুক্ত হতে পারছে না। ঢাকা ওয়াসার মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ১১টি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। যার মধ্যে প্রথম পর্যায়ে পাঁচটি এবং দ্বিতীয় দফায় ছয়টি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে পাগলা, দাশেরকান্দি, উত্তরা, মিরপুর ও রায়েরবাজারে পাঁচটি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে টঙ্গী, সাভার, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, ডেমরা ও নারায়ণগঞ্জে ছয়টি পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হবে। অগ্রাধিকার হিসেবে খিলগাঁও এলাকার দাশেরকান্দিতে এটি নির্মাণ করা হচ্ছে। যার ধারণক্ষমতা ৫০০ এমএলডি। এখানে ১০ কিলোমিটার ট্যাংক সুয়ারেজ লাইন করতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের পর্যালোচনা থেকে জানা গেছে, উৎসে দূষণের কারণে ভয়াবহ হুমকিতে পড়েছে সায়েদাবাদের পানি শোধনাগার প্রকল্প। এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন সরবরাহকৃত ৪৫ কোটি লিটার ব্যবহারযোগ্য পানির বিশুদ্ধতা নিয়ে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে রাজধানীবাসীকে অজান্তেই ব্যবহার করতে হচ্ছে দূষিত পানি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা থাকলেও তা হয়নি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৫৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। কমিশন বলছে, এই ধরনের প্রকল্প দুই ভাগে ভাগ করে বাস্তবায়ন করা উচিত। প্রথমত ভূমি অধিগ্রহণ এবং মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন। তাহলে মূল কাজ জটিলতায় পড়ে না।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/505277