২১ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ৪:১৯

আম্পানে লণ্ডভণ্ড উপকূল

১৫ জেলার মানুষের নির্ঘুম রাত * সন্ধ্যায় ‘প্রবল ঘূর্ণিঝড়’ আকারে পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ দিয়ে উপকূলে প্রবেশ * আছড়ে পড়ার সময়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ১৮০ কিলোমিটার * এবারও ‘রক্ষাকবচ’র ভূমিকায় সুন্দরবন

‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় আম্পান (প্রকৃত উচ্চারণ উম-পুন) বুধবার বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলে আঘাত হেনেছে। বিকাল ৪টার দিকে এটি ভারতের সাগর দ্বীপের পূর্বপাশ দিয়ে সুন্দরবনসংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম শুরু করে। ঘূর্ণিঝড়ের মূল কেন্দ্র বা চোখটি পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসতে আড়াই ঘণ্টার বেশি সময় নেয়। তবে পুরো ঝড়টির উপকূলে উঠতে সময় লাগে প্রায় ৬ ঘণ্টা। সেই হিসাবে সন্ধ্যা ৭টার দিকে চোখ বা কেন্দ্র এবং গোটা ঝড়টি রাত সাড়ে ৯টার দিকে উঠে যায় স্থলভাগে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর এটি সুন্দরবনে ঢুকে পড়ে। আম্পানের ডানদিকের অংশ ছিল খুবই জোরালো। এই অংশ তাণ্ডব চালায় বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশসহ আশপাশের জেলায়। সেখান থেকে ভয়ংকর রূপ নিয়ে ঢুকে পড়ে সাতক্ষীরা ও খুলনায়। এ দুই জেলা লণ্ডভণ্ড করার পর এগিয়ে যায় ঝিনাইদহ, যশোর ও নড়াইলে। রাত ২টার দিকে এটি মাগুরা, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

এরআগে বেলা ৩টার দিকে আম্পানের অগ্রভাগ পৌঁছায় পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে। একই সময়ে এটি বাংলাদেশের উপকূলও স্পর্শ করে। উপকূলে আছড়ে পড়ার সময়ে আম্পানের বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটার। আর সাতক্ষীরা অতিক্রমকালে এর গতিবেগ ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার ছিল। এভাবে বিকাল থেকে রাতভর বয়ে যায় ঝড়টি। ফলে বাংলাদেশ-ভারতের উপকূলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। রাত দেড়টায় এ রিপোর্ট লেখাকালে পটুয়াখালী ও ভোলায় ২ জন করে ৪ জন এবং পিরোজপুর ও সাতক্ষীরায় একজন করে ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। অন্য ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন জেলায় শত শত বাড়িঘর ও গাছপালা ভেঙে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। ভেসে গেছে মাছের ঘের-পুকুর। নষ্ট হয়েছে মাঠের রবিশস্যসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল। ঝড়ের কারণে বাংলাদেশের উপকূলের ১৫ জেলার লাখ লাখ মানুষের বুধবারের রাতটি নির্ঘুম কেটেছে। এসব এলাকার প্রায় ২৪ লাখ মানুষকে ১৪ হাজার ৩৩৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে।

ঝড়টির একটি বড় অংশ এবারও সামাল দেয় পৃথিবীর বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এ ‘রক্ষাকবচ’ আম্পানকে কিছুটা দুর্বল করার ক্ষেত্রে এবারও ভূমিকা রেখেছে। এরআগে গত বছরের নভেম্বর ও এপ্রিলে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এবং ফণীও সুন্দরবনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিল।

বেলা ৩টায় ঝড়টির গতিবিধি ও তীব্রতা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর (বিএমডি) বলেছে, ঝড়টির কেন্দ্র থেকে ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ১৮০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া আকারে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ছিল। পরে সন্ধ্যা ৬টায় পরবর্তী বিশেষ বুলেটিনে (৩৫ নম্বর) সংস্থাটি আরও জানায়, ঝড়টি পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ১৬০ কিলোমিটার। যা ১৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংস্থাটি রাত ৯টা ও ১২টার বিশেষ বুলেটিনেও বলেছে একই কথা।

আর ভারতীয় আবহাওয়া অধিদফতর (আইএমডি) বলেছে, পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে আছড়ে পড়ার সময়ে বাতাসের একটানা গতিবেগ ছিল ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার। এ গতিবেগ বেড়ে ১৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হয়েছিল। এরআগে বুধবার সকাল থেকে গড়ে ২২ থেকে ২৯ কিলোমিটার বেগে উপকূলের দিকে এগোচ্ছিল আম্পান। স্থলভাগে উঠে ঝড়টি এগিয়ে যায় কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য এলাকার দিকে। উপকূলের কাছাকাছি আসার পর অজানা কারণে এর গতি বেড়ে যায়। এ আচরণের জন্য উভয় দেশ প্রস্তুত ছিল না বলে জানান বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, উপকূলে আসার পর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়া সাগরের ‘সুপার ঘূর্ণিঝড়’ আম্পানের চরিত্র ‘সুপার ঘূর্ণিঝড়’র মতোই ভয়ংকর ছিল।

আম্পানের প্রভাবে বুধবার দুপর থেকেই গোটা উপকূল অস্থির হয়ে উঠে। বয়ে যায় প্রচণ্ড ঝড়ো হওয়া। সঙ্গে ছিল বৃষ্টিপাত। কোথাও ঝিরিঝিরি আবার কোথাও ভারি। যত বেলা কমতে থাকে ততই বাড়তে থাকে ঝড়ের তাণ্ডব আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। সন্ধ্যা ঘনাতেই তা প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া আর প্রবল বৃষ্টিপাতে রূপ নেয়। সঙ্গে ছিল জলোচ্ছ্বাস। বিএমডি আগেই ঘোষণা করেছিল, অমাবস্যার জো’তে এ ঝড়ের আবির্ভাবের কারণে উপকূলীয় এবং চরাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়েও ১০-১৫ ফুট উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। রাত দেড়টায় এ রিপোর্ট লেখাকালে উপকূলীয় জেলাগুলো থেকে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাসের খবর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ, রাস্তা ভেঙে বা বাঁধ ও রাস্তা উপচে লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ে। জোয়ারের সময়ে আম্পানের আঘাত আর অমাবস্যার জো হওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে জানান বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম।

আবহাওয়াবিদরা জানান, ঘূর্ণিঝড়ের মূল গন্তব্য বাংলাদেশ। রাত দেড়টার দিকে এ রিপোর্ট লেখাকালে ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান করছিল। এর প্রভাবে উভয় দেশে তুমুল বৃষ্টি ও দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এটি প্রায় ১২ ঘণ্টা দাপট চালাবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশে। আজ দুপুরের পর এর কেন্দ্র গভীর নিম্নচাপ আকারে প্রবেশ করতে পারে বাংলাদেশে। দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রাজশাহীর উপর দিয়ে এটি বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। পরে এটি স্থল নিম্নচাপ আকার ধারণ করবে। এটি ময়মনসিংহ অঞ্চল হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দিকে চলে। চলার পথে প্রচুর বৃষ্টি ঝরাবে। বৃষ্টি ঝরিয়েই শক্তি ক্ষয় করবে আম্পান। এরপর বিলীন বা অর্থহীন হয়ে যাবে।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বুধবার দুপুরেই মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে এবং তিন বিভাগের (খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম) ১১ জেলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করা হয়েছিল। এছাড়া কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রাম বিভাগের ৪ জেলায় ছিল ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। গোটা উপকূলজুড়ে এখনও সতর্কতা জারি করা আছে।

সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বিএমডির তিনটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আম্পানের প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চলেও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি থাকবে। পাশাপাশি নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি থাকবে। এতে আরও বলা হয়, উল্লিখিত জেলাগুলো এবং এর দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ১০-১৫ ফুটের অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। এছাড়া এসব জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো বাতাসসহ ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টি হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে থাকা নৌযানগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মলিক যুগান্তরকে জানান, এ ধরনের ঝড় অনেকটা স্থানজুড়ে আঘাত হানে। আম্পানের বাংলাদেশ এবং ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে আছড়ে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু উপকূলে আসার আগে এটির গতিপথ পশ্চিম দিকে সরে যায়। ওই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের উপকূল অতিক্রম করে সন্ধ্যা ৬টার দিকে। যদি ঝড়ের বিদ্যমান গতি অটুট থাকে তাহলে পরে রাজশাহী অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারে।

এ আবহাওয়াবিদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়কে চারভাগে ভাগ করা হলে এর ডান পাশে বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিকই ছিল বাংলাদেশ অংশে। যে কারণে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা ও পটুয়াখালীর উপকূল প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ আছে। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস থাকে। সবচেয়ে আতঙ্কের হয় যদি আঘাত হানার সময়ে সাগরে জোয়ার এবং অমাবস্যা-পূর্ণিমার মৌসুম থাকে। তখন জলোচ্ছ্বাস বেড়ে যায়।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মূল ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশে আঘাত করেনি। এর ডানদিকের অগ্রভাগের অংশবিশেষ বুধবার বিকাল থেকে বাংলাদেশ অতিক্রম করা শুরু করে। অতিক্রম করা শেষ হয় সকাল নাগাদ। মূল কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে বর্ধিতাংশ থাকায় আমরা আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছি। পশ্চিমবঙ্গে আঘাতকালে ঘূর্ণিঝড়টি ক্যাটাগরি-৩ বা ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড় আকারে ছিল। বাংলাদেশে যখন পৌঁছায় তখন তা ক্যাটাগরি-১ পর্যায়ে নেমে আসে। তবে এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিতে হয়। জনগণের জানমাল রক্ষার্থে সরকার আগেভাগে ব্যাপকভাবে সতর্ক ও প্রস্তুত ছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে মঙ্গলবার থেকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন ও দিকনির্দেশনা দেন। তারই নির্দেশে জনগণের জানমাল রক্ষার্থে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়ে এ ঝড়ের কারণে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বাড়তি পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। সরকারের নির্দেশে দুর্যোগ মোকাবেলায় উপকূলজুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল প্রশাসনের। সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত ছিল, যেখানে সোমবার রাত থেকেই জনগণকে নেয়া শুরু হয়। যদিও অনেকে ঘরবাড়ি ও গবাদি পশু রেখে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চায়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিএমএ যৌথভাবে বিপুলসংখ্যক মেডিকেল টিম গঠন করে।

যুগান্তর প্রতিনিধিরা জানান, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিভিন্ন স্থান থেকে গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়া এবং ঘরের চালা উড়িয়ে নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। সাগরে এবং উপকূলের নদ-নদীতে বেড়েছে জোয়ারের পানি। এ কারণে মঙ্গলবার দুপুরের মধ্যেই ৬-৭ ফুটের জলোচ্ছ্বাসে খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, কক্সবাজারসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার চর ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে বিভিন্ন চর। স্রোতের তোড়ে অনেক স্থানে ভেঙে গেছে বেড়ি বাঁধ। সেই ভাঙা দিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে লবণাক্ত পানি। কোথাও ভেসে গেছে মাছের ঘের।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/309061/