ফাইল ছবি
১৮ মে ২০২০, সোমবার, ৩:১০

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য

গুদাম ভাড়া মওকুফ নিয়ে বিমানের তুঘলকি কাণ্ড

চট্টগ্রাম বন্দরের স্টোর রেন্ট মওকুফের সীমা বাড়াতে বিজিএমইএ’র চিঠি

বিমানের গুদাম ভাড়া মওকুফ নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড চলছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাও মানছে না বিমান কর্তৃপক্ষ। ‘লকডাউন চলাকালীন’ পর্যন্ত স্টোরেজ চার্জ মওকুফে মন্ত্রণালয় থেকে বিমানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

দুই দফা নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বিমান ১০ মে পর্যন্ত স্টোরেজ চার্জ মওকুফ করলেও পরে সময়সীমা আর বাড়ায়নি। এমনকি বর্তমানে খালাস নেয়া পণ্যে মওকুফকৃত সময়ের গুদাম ভাড়া নেয়া হচ্ছে।

বিমানের এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের কারণে শিল্প মালিক ও সাধারণ আমদানিকারকরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

জানা যায়, ২৯ এপ্রিল গুদাম ভাড়া মওকুফে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয় থেকে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয়া হয়।

এতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চ থেকে সরকারি সিদ্ধান্ত মতে লকডাউন চলমান। এ কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং যাতায়াত ব্যবস্থা সীমিত রয়েছে।

সরকার ২৬ মার্চ থেকে ‘লকডাউন চলাকালীন পর্যন্ত’ আমদানিকৃত এবং বিমানের ওয়্যারহাউসে রক্ষিত সব পণ্যের ফ্রি টাইম পরবর্তী স্টোরেজ চার্জ মওকুফের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তাই ওয়্যারহাউসে রক্ষিত ডেলিভারির জন্য অপেক্ষমাণ সব পণ্যের ফ্রি টাইম পরবর্তী স্টোরেজ চার্জ মওকুফে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হল।

এরপরই বিমান কর্তৃপক্ষ ৩০ এপ্রিল এক আদেশ জারির মাধ্যমে ১০ মে পর্যন্ত চার্জ মওকুফ করে। এ সুবিধা দেয়া হয় শুধু লকডাউনকালীন আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে।

একই সঙ্গে গুদাম ভাড়া পরিশোধ করে যারা পণ্য খালাস নিয়েছেন তারা এই সুবিধা পাবেন না। অর্থাৎ ২৬ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ভাড়া পরিশোধ করে যারা পণ্য নিয়েছেন তারা সেই টাকা ফেরত পাবেন না।

ভুক্তভোগী শিল্প মালিক ও আমদানিকারকরা বলছেন, সরকার ৩০ এপ্রিলের পর আরও দুই দফায় ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি/লকডাউনের মেয়াদ বাড়ায়।

কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ ১০ মে পর্যন্ত ডেমারেজ মওকুফ করে, তাতেও নানা শর্ত জুড়ে দেয়। এক্ষেত্রে বিমান স্পষ্টত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করেছে। কারণ মন্ত্রণালয় থেকে বিমানকে নির্দেশ দেয়া হয়, ‘লকডাউন চলাকালীন পর্যন্ত’ ডেমারেজ মওকুফ করতে। বিমান নতুন করে অর্ডার না করায় আমদানিকারকরা বিপাকে পড়েছেন।

তারা বলছেন, লকডাউন চলাকালীন জরুরি সেবার আওতায় বিমানবন্দর ও কাস্টমস খোলা থাকলেও অন্য সেবা খাতের অনেকাংশই বন্ধ বা সীমিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করায় পণ্য খালাসে অনিচ্ছাকৃত দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়।

সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বিত পদক্ষেপের অভাবে চাইলেও আমদানিকারকরা পণ্য খালাস নিতে পারেননি। এখন পুরো দায়ভার ব্যবসায়ীদের বহন করতে হচ্ছে। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ শিল্পের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

যা শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতাকে হ্রাস করবে। শিল্প মালিকদের অভিযোগ, বর্তমানে গুদাম ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে বিমান স্বেচ্ছাচারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

যেমন ২৬ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত গুদাম ভাড়া মওকুফ করা হয়। এ সময়ের পরে গত এক সপ্তাহে যেসব পণ্য খালাস নেয়া হয়েছে বা নেয়ার প্রক্রিয়া চলমান আছে সেসব পণ্যে অযৌক্তিকভাবে মওকুফকৃত সময়ের গুদাম ভাড়া দাবি করা হচ্ছে। অর্থাৎ পণ্য খালাস নিতে হলে মওকুফকৃত ৪৪ দিনেরও ভাড়া দিতে হবে শিল্প মালিক ও সাধারণ আমদানিকারকদের। যা বর্তমানে কারও পক্ষেই বহন করা সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, গুদাম ভাড়া মওকুফের বিষয়ে বিমানের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক, অগ্রহণযোগ্য। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নানা সুবিধাদি দিলেও বিমান একেবারে নির্বিকার, যা মোটেও কাম্য নয়।

প্রধানমন্ত্রী যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যকে গতিশীল রাখতে একের পর এক প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে যাচ্ছেন, তখন বিমান ১০ মে পর্যন্ত ডেমারেজ মওকুফ করেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা যুক্তিযুক্ত নয়। তাছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়েছিল ১৬ মে পর্যন্ত মওকুফ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, শিল্প মালিক ও আমদানিকারকরা কয়েকশ’ গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বিমানে পণ্য আনেন। এ অবস্থায় ডেমারেজ আদায় করায় শিল্প উদ্যোক্তা ও সাধারণ আমদানিকারকদের লোকসানের পাল্লা আরও ভারি হবে। তাছাড়া এখন বৃষ্টির মৌসুম চলছে। এখন মালামাল খালাস না নেয়া হলে তা বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যাবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ অবস্থায় অন্তত আরও ৭ দিন ডেমারেজ মওকুফ করা উচিত।

ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এসএমএ খায়ের বলেন, লকডাউনে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নানা ছাড় দিলেও বিমান এক্ষেত্রে উদাসীন। ১০ মে পর্যন্ত ডেমারেজ মওকুফ করা হলেও নানা শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। তাতেও পণ্য খালাসে আমদানিকারকদের আপত্তি ছিল না।

কিন্তু এরপর দুই দফা লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হলে আগের মতো অন্য সংস্থাগুলো সীমিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এতে একটি চালানের কাগজ প্রস্তুত করতে অনেক দিন সময় লেগে যায়। তিনি বলেন, ডেমারেজ চার্জ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, ব্যবসায়ীরা এখন আর মালামাল নিতে চাচ্ছেন না। এ ধরনের মালামাল গুদামে পড়ে থাকায় জট সৃষ্টি হচ্ছে।

অন্যদিকে বিমানের আদেশে বলা হয়েছে, ২৬ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত খালাস নেয়া পণ্যের ক্ষেত্রে মওকুফ সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে গুদাম ভাড়া দিয়ে পণ্য খালাস নেয়া হলে ওই ভাড়ার টাকা ফেরত দেয়া হবে না। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আদায়কৃত স্টোররেন্ট ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, লকডাউনকালীন আমদানিকৃত কনটেইনার বন্দর ভাড়া পরিশোধ করে যারা খালাস নিয়েছেন তাদের টাকা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেটি আদেশ আকারে জারি হয়নি। শিল্প মালিকরা টাকা ফেরত চেয়ে নৌ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারেন। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবে।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন বলেন, গুদাম ভাড়া মওকুফের সময়সীমা নতুন করে বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। কারণ যখন গুদাম ভাড়া মওকুফ করা হয়েছিল তখন গাড়ি চলাচল, বন্দর, কাস্টমস সবকিছুই বন্ধ ছিল।

এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে কাস্টমস পূর্ণাঙ্গরূপে কার্যক্রম শুরু করে, গুদাম থেকে ডেলিভারি শুরু হয়, যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়। গুদাম পাহারা, মেইনটেন্যান্স খরচ বিমানকে বহন করতে হয়েছে।

লকডাউন চলাকালীন চট্টগ্রাম বন্দরের স্টোররেন্ট মওকুফ চায় বিজিএমইএ : লকডাউন চলাকালীন চট্টগ্রাম বন্দরের স্টোররেন্ট মওকুফের আহ্বান জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বিজিএমইএ ।

১৪ মে দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে কার্যক্রম শুরু করলেও আমদানিকৃত কনটেইনার খালাসে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাগজপত্র প্রাপ্তিতে সমস্যা ও জটিলতার কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য চালান খালাস করা যাচ্ছে না। জাতীয় রফতানির বৃহত্তর স্বার্থে তৈরি পোশাক শিল্পের আমদানিকৃত পণ্য চালান দ্রুত খালাসে যতদিন সরকার ঘোষিত লকডাউন বলবত থাকবে ততদিন পর্যন্ত ডেমারেজ চার্জ মওকুফের সময়সীমা বৃদ্ধি করা আবশ্যক।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/308124/