ফাইল ছবি
১৮ মে ২০২০, সোমবার, ৩:০৭

নমুনা পরীক্ষার ১৫ শতাংশই করোনাক্রান্ত: ভিয়েতনাম মডেল মেনে চলার পরামর্শ

দেশটিতে এই রোগে কোনো মৃত্যু নেই আক্রান্ত ৩১৮ * শুরু থেকেই তিন স্তরের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের গুরুত্ব দিতে হবে * স্বাস্থ্য ফরমে দেয়া তথ্য ভুল প্রমাণিত হলে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে * করোনা নিয়ন্ত্রণে ভিয়েতনাম মডেলটি সবচেয়ে সফল -ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন

দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যু। এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি।

দেশে বর্তমানে সংক্রমণের হার প্রায় ১৫ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে সামনে এই মহামারী আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা আছে।

এর ভয়াবহতা রোধে করোনা নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীর সবচেয়ে সফল রাষ্ট্র ভিয়েতনামের মডেল অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলেন, চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হয়েও ভিয়েতনাম করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে সফল। তারা প্রথম রোগী পাওয়ার পর থেকেই তিন স্তরের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সব উৎস বন্ধ করে দিতে পেরেছে।

ফলে যখন সারাবিশ্ব এই ভাইরাসের দাপটে কাঁপছে, লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। তখন ভিয়েতনাম তার রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে, কোনো মৃত্যু ছাড়াই।

এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) ভাইরোলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি যে অবস্থায় পৌঁছেছে সেখান থেকে ফিরতে হলে ভিয়েতনাম মডেল অনুসরণ করতে হবে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে ভিয়েতনামে মাত্র ১০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। তখন থেকেই কঠোরভাবে এসব রোগীর প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং সম্পন্ন করে তাদের কঠোরভাবে সঙ্গনিরোধ (আইসোলেশন) করা হয়।

ফলে এসব রোগীর মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে পৃথিবীতে ভিয়েতনাম মডেলটি সবচেয়ে সফল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রোগতত্ত্ববিদ যুগান্তরকে বলেন, মাসের পর মাস লকডাউন করে রেখে দেশে চালানো সম্ভব নয়। তাই যেসব এলাকায় সংক্রমণ কম সেসব এলাকায় লকডাউন শিথিল করতে হবে।

যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি সেখানে কঠোরতা আরোপ করতে হবে। জেলা থেকে জেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। পাশাপাশি ভিয়েতনামের মতো তিন স্তরের কন্ট্রাক ট্রেসিংয়ে গুরুত্বারোপ করতে হবে।

জানা গেছে, জনসংখ্যা সাড়ে নয় কোটির বেশি এবং চীনের সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ স্থল সীমান্ত। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অনেক ধরনের যোগাযোগ।

চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের মহামারীতে পুরো বিশ্ব যখন বিপর্যস্ত তখন ভিয়েতনামে করোনাভাইরাসে মৃত মানুষের সংখ্যা শূন্য। আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৩১৮ জন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ভিয়েতনামের এই সাফল্যে বিস্মিত। দেশটির এই সাফল্যের কারণ বোঝার চেষ্টা করেছেন দু’জন গবেষক।

এদের একজন লন্ডনের কিংস কলেজের পলিটিক্যাল ইকোনমির সিনিয়র লেকচারার রবিন ক্লিংগার-ভিড্রা এবং ইউনিভার্সিটি অব বাথের পিএইচডি গবেষক বা-লিন ট্রান। এই দুই গবেষক তাদের অনুসন্ধানের ফল প্রকাশ করেছেন গ্লোবাল পলিসি জার্নালে।

তারা ভিয়েতনামের এই সাফল্যের জন্য মূলত কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করছেন। তারা বলেছেন, ভিয়েতনামে করোনাভাইরাসের ব্যাপারে শুরু থেকেই ভালোভাবে সতর্ক করে দিয়েছে সরকার।

গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ওই দেশের সরকার করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বেশ কড়াকড়ি ব্যবস্থা নিয়েছিল। তাদের সব বিমানবন্দরে যাত্রীদের কঠোরভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা হয়েছিল।

বিমানবন্দরে এসে নামা যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হতো এবং তাদের একটি স্বাস্থ্য-ফরম পূরণ করতে হতো। সেই ফরমে যাত্রীদের উল্লেখ করতে হতো তারা কার কার সংস্পর্শে এসেছে, কোথায় কোথায় গিয়েছে।

এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা এখনও চালু আছে। দেশটিতে যে কোনো বড় শহরে ঢুকতে বা সেখান থেকে বেরোতে গেলে এসব তথ্য এখনও জানাতে হয়। কোনো সরকারি দফতর বা হাসপাতালে ঢুকতে গেলেও এসব তথ্য দিতে হয়।

কারও শরীরের তাপমাত্রা যদি ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর থাকে তখন তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য।

স্বাস্থ্য ফরমে যারা ভুল তথ্য দিয়েছে বলে প্রমাণিত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি প্রথম থেকেই দেশজুড়ে বিপুল পরিসরে টেস্টিং এবং কনট্যাক্ট ট্রেসিং (আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে কারা কারা এসেছিল) এর ব্যবস্থা নিয়েছিল ভিয়েতনাম।

কোনো এলাকায় মাত্র একটি সংক্রমণ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকা লকডাউন করে দেয়া হয়েছে।

ভিয়েতনামে দ্বিতীয় যে বিষয়টির ওপর জোর দেয়া হয়েছিল সেটা হচ্ছে টার্গেট করে করে কঠোর কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা চালু। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে যেসব ভিয়েতনামি নাগরিক বিদেশ থেকে ফিরেছে তাদের আসার পর ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছে এবং কোভিড-নাইনটিনের জন্য টেস্ট করা হয়েছে।

ওই দেশে আসা বিদেশিদের বেলাতেও এই একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এমনকি দেশের ভেতরেও একটি বড় নগরী থেকে আরেকটি বড় নগরীতে যেতে হলে সেখানে একই ধরনের কোয়ারেন্টিনের নীতি চালু রয়েছে।

বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এখনও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কেউ যদি কোনো শহরের স্থায়ী বাসিন্দা না হন, তিনি যদি সেখানে ঢুকতে চান, তাকে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিনে থাকতেই হবে।

সেটা হতে হবে সরকার অনুমোদিত কোনো একটি স্থাপনায়। এর খরচ তাদের নিজেকেই বহন করতে হবে।

ভিয়েতনামের সাফল্যের জন্য গবেষকরা তৃতীয় যে বিষয়টির উল্লেখ করছেন, সেটি হচ্ছে তাদের সফল গণসংযোগ। শুরু থেকেই সরকার এই ভাইরাসটি যে কত মারাত্মক সে ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের বার্তাটি ছিল স্পষ্ট।

কোভিড-নাইনটিন শুধু একটা খারাপ ধরনের ফ্লু নয়, তার চেয়েও মারাত্মক কিছু এবং জনগণকে তারা পরামর্শ দিয়েছিল কোনোভাবেই যেন তারা নিজেদের ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে।

সরকার বেশ সৃজনশীল কিছু কৌশল নিয়েছিল জনগণের কাছে করোনাভাইরাসের বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য। প্রতিদিন সরকারের প্রধানমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা নাগরিকদের মোবাইল ফোনে টেক্সট পাঠাতেন করোনাভাইরাসের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে।

এর পাশাপাশি সরকারি প্রচারণা তো ছিলই। ভিয়েতনামের সব শহরে পোস্টার লাগানো হয়েছে এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জনগণকে তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে।

তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। কাজেই ভিয়েতনাম অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটা উদাহরণ হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

এদিকে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। রোববার রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে কোভিড-১৯ অস্থায়ী হাসপাতালের কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেন, ভিড় কমাতে না পারলে সংক্রমণ আরও বাড়বে।

তিনি বলেন, রাস্তায় যানবাহন, অনেক লোকের চলাফেরা, দোকানে, শিল্প কারখানার সামনে, ফেরিঘাটে অনেক লোক জমা হচ্ছে। এসব দেখে আমরা আতঙ্কিত হই। এতে সংক্রমণ বাড়ে।

তিনি বলেন, আপনারা লক্ষ্য করছেন, সংক্রমণ কিছুটা বেড়েছে। আমরা যদি বাইরে যাওয়া না কমাই তাহলে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য ঢাকার ১৪টি হাসপাতালে ৩ হাজার শয্যা আছে। বসুন্ধরার হাসপাতাল এবং সিটি কর্পোরেশনের অস্থায়ী আইসোলেশন হাসপাতাল মিলিয়ে সাড়ে সাত হাজার আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী শনিবার পর্যন্ত দেশে ২২ হাজার ২৬৮ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত করা গেছে, মৃত্যু হয়েছে ৩২৮ জনের।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/308123