১৭ মে ২০২০, রবিবার, ৯:৩৯

কেনাকাটায় সামাজিক দূরত্ব উপেক্ষিত

সামাজিক দূরত্ব না মেনেই রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে চলছে ঈদের পণ্য কেনাবেচা। বেশির ভাগ দোকান ও মার্কেটে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ক্রেতা ও বিক্রেতারা অনেকটাই ঘা ঘেঁষাঘেঁষি করে পণ্য বিকিকিনি করছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যেও কোথাও কোথাও ছোটখাটো জটলাও দেখা গেছে।

বিশেষ করে ফুটপাতের দোকানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বালাই ছিল না। সেখানে অনেককেই মুখে মাস্ক ব্যবহার না করেই ঘুরতে দেখা গেছে। তবে কিছুটা ভিন্ন চিত্র ছিল কয়েকটি শোরুম ও সুপারশপে। সেসব শোরুমে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে দেখা গেছে।

এদিকে চিরচেনা ক্রেতা সমাগম নেই এবার ঈদ বাজারে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় ক্রেতা অনেক কম থাকায় হতাশ বিক্রেতারা। শনিবার রাজধানীর কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। যদিও করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে বেশির ভাগ বড় শপিংমল ও মার্কেট বন্ধ রয়েছে।

নিউমার্কেট-সায়েন্সল্যাব এলাকা : রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব, ঢাকা কলেজ, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, সিটি কলেজ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শনিবার ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এ এলাকার অনেক মার্কেট ও দোকানে চলছে ঈদের কেনাকাটা। এসব মার্কেটে সামাজিক দূরত্ব মানার নির্দেশনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।

দোকানের সামনের জায়গার পরিধি ছোট হওয়ায় অনিচ্ছাকৃতভাবেই ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরের কাছাকাছি চলে আসছেন। জায়গার কথা ভেবে কেউ একজনের বেশি দোকানে প্রবেশের সুযোগ না দিলেও বাইরে লেগে যাচ্ছে ছোটখাটো জটলা। দোকানের বাইরে বৃত্ত এঁকে ঘর করা থাকলেও সেটা অনেকেই খেয়াল করছেন না।

আরও দেখা গেছে, সকালে অল্প পরিসরে দোকানপাট খোলা ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে তা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে আছে তৈরি পোশাক, শিশুদের কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, কসমেটিক্স, জুতা, বেল্ট, পাঞ্জাবির দোকান। এলিফ্যান্ট রোডে খোলা ছিল আজিজ সুপার মাকের্ট, সুবাস্তু টাওয়ার, মনসুর ভবন, শওকত ভবন, সানরাইজ ভবনের জিএম প্লাজা, টপটেন, বেলমন্ট ইত্যাদি মার্কেট।

সরেজমিন দেখা গেছে, নিউমার্কেট এলাকায় ধানমণ্ডি হকার্স মার্কেট বন্ধ থাকলেও মার্কেটের বাইরের অংশের দোকান প্রায় সবগুলোই খোলা। এই দোকানগুলোর আকার অনেক ছোট। দুই-তিনজন ক্রেতা প্রবেশ করলেই দোকান ভরে যায়। এসব দোকানে মূলত শিশুদের তৈরি পোশাক বিক্রি করা হয়।

এছাড়া আছে লুঙ্গি এবং সালোয়ার-কামিজের দোকান। এখানকার ব্যবসায়ী ও দোকানের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দোকানে তারা একজনের বেশি ক্রেতা প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। তবে ক্রেতারা তা মানতে নারাজ। একই সঙ্গে কয়েকজন ক্রেতা ঢুকে যাচ্ছেন। তাদের আটকানো যাচ্ছে না।

এলিফ্যান্ট রোডে অবস্থিত জিএম প্লাজার এক কর্মচারী জানান, তারা ক্রেতাদের পোশাকে হাত দিতে দিচ্ছেন না। তাছাড়া সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে বাইরে দাগ কেটেছেন। এই মার্কেটের হেভেন টেইলার্সের মালিক ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমরা দোকান সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখি।

এছাড়া আমরা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই। পোশাক পছন্দ করলে সেটা দিই। তিনি আরও বলেন, ‘গত দেড় মাস বন্ধ থাকায় আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা আগামী দুই বছরে পোষাতে পারব না। ক্রেতা আসে, তবে খুব একটা না। ঈদের আগে যতসংখ্যক ক্রেতা আসার কথা সে রকম নেই।

ঢাকা কলেজের সামনে অবস্থিত হকার্স মার্কেটের এক জিন্স প্যান্ট বিক্রেতা জানান, তারা ক্রেতাদের শাড়ি ধরার আগে হাত জীবাণুমুক্ত করার কথা বলছেন। অনেক ক্রেতা বিরক্ত হচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

মনসুর ভবনের এক কর্মচারী জানান, তাদের দোকানের পণ্য ক্রেতাদের ধরতে দেয়া হচ্ছে না। ক্রেতার যেটা পছন্দ সেটা নিজেদের হাতে দেখিয়ে ক্রেতাকে প্যাকেট করে দেয়া হয়। তাছাড়া পণ্য পরিবর্তন কিংবা ফেরতের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘কাস্টমারকে ধরতে না দিলেও অনেকে বিরক্ত হয়। আমরা বলি, কিছু করার নেই।’

ঈদে সবচেয়ে বেশি চাহিদা পাঞ্জাবির থাকলেও করোনা পরিস্থিতিতে ক্রেতা নেই পাঞ্জাবির দোকানগুলোতে। তাই অলস সময় পার করছেন বিক্রেতারা। এসব দোকানের সামনে কর্মচারীদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার নিয়ে দোকানের বাইরে অবস্থান করতে দেখা গেছে।

সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার পাঞ্জাবির দোকানে ‘লংলা’র এক কর্মচারী বলেন, ‘ক্রেতাদের নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবি পছন্দ করতে হয়। দোকানের ভেতরে দাগ কাটা আছে। আর পাঞ্জাবি ধরে দেখার সুযোগ নেই।

মিরপুর এলাকা : করোনাকালে ঈদ সামনে রেখে মিরপুরের দোকানপাট খোলা থাকলেও আশানুরূপ ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না বিক্রেতারা। ফুটপাতের দোকানপাটে কিছুটা ক্রেতার দেখা মিললেও মার্কেটগুলো প্রায় ফাঁকা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনার মধ্যে খুব বেশি ক্রেতা হবে না, তা তারা ধরেই নিয়েছিলেন।

কিন্তু তার পরও যে আশা করেছিলেন, তার থেকেও ৩০-৪০ শতাংশ কম ক্রেতা পাচ্ছেন তারা। প্রাণঘাতী করোনা আতঙ্কে দীর্ঘদিন ঘরবন্দি নগরবাসী আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কেনাকাটায়।

মিরপুর এক নম্বরে নিউমার্কেটে শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, যেসব দোকানে অন্য সময়ে উপচে পড়া ভিড় লেগে থাকত সেসব দোকান অনেকটাই ফাঁকা। মিরপুর-১ নম্বরে নিউমার্কেটে ইজি ফ্যাশনের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ইমরান হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঈদ উপলক্ষে আমাদের বিশাল প্রস্তুতি ছিল।

কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে দোকান খোলা সম্ভব হয়নি। সরকার ঘোষণা দেয়ার পর ১০ মে থেকে আমরা সব নিয়ম-কানুন মেনে দোকান খুলেছি। কিন্তু আশানুরূপ ক্রেতা নেই।

একই মার্কেটের এপেক্স শোরুমের সিনিয়র ম্যানেজার নূরউদ্দিন রাজু যুগান্তরকে বলেন, ক্রেতা নেই। বেচাবিক্রি সম্পর্কে তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও কয়েকগুণ কম হচ্ছে। আর টপটেনের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার আতাহারুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, এই ব্রাঞ্চ ঢাকার মধ্যে অন্যতম বড় ব্রাঞ্চ।

অন্য বছর এখানে লোকে লোকারণ্য থাকে। কিন্তু এ বছর ক্রেতা নেই বললেই চলে। কাউন্টারগুলো ফাঁকা। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও এবার ক্রেতার সংখ্যা অনেক কম।

এ মার্কেটে কথা হয় আল্পনা বেগম নামের একজন ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, মেয়েদের জন্য জামার কাপড় কিনতে এসেছি। তিনি বলেন, এবারের ঈদ তো আর অন্য বছরের মতো হবে না। কেনার প্রয়োজন তাই কিনতে এসেছি। সেখানে আরেক ক্রেতা সালাহউদ্দিন জানান, একটি শার্ট বানাব, তাই কাপড় পছন্দ করতে এসেছি। দেখছি কেনা যায় কিনা।

মিরপুর নিউমার্কেটের অন্যতম পরিচালক আবদুল ওয়াহেদ হাওলাদার সেলিম যুগান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমরা মার্কেট খুলেছি। হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, জীবাণুনাশক টার্মিনালসহ সব ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। পল্লবী এলাকার নিউ সোসাইটি মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাদের মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, মার্কেটে সুরক্ষা নিশ্চিত করে দোকানপাট খুলেছি।

কিন্তু অন্য বছরের তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা এবার অনেক কম। মিরপুর পোস্ট অফিসের সামনের ফুটপাতে ভ্যানে জামা-কাপড় নিয়ে বসেছেন কবির হোসেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মাত্র দু’শ টাকার বিক্রি করেছি। তিনি বলেন, দোকান খুলে দাঁড়িয়েছি, তাও যদি ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হয়।

যাত্রাবাড়ী এলাকা : রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন মার্কেট এবং টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখা হলেও কেনাকাটায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হয়নি। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার চারপাশে ভ্যানে করে বা ক্ষণস্থয়ী দোকান বানিয়ে ঈদের পোশাক বিক্রি করতে দেখা গেছে।

নিম্ন আয়ের মানুষজন এখান থেকে কেনাকাটা সেরে নিচ্ছেন। অধিকাংশ ক্রেতাই মুখে মাস্ক পরে থাকলেও তারা কেনাকাটার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার তোয়াক্কা করছেন না। ফুটপাতে ছোটদের পোশাক কিনতে আসা আখলিমা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, মেয়ের জন্য ড্রেস কিনতে এসেছি। ঈদ সিজনে কেনাকাটা করতে গেলে একটু ভিড় হবেই। এখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করা কঠিন। ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই।

টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। শনিবার সকালে মার্কেটের প্রবেশপথে দু’জন গার্ডকে ক্রেতাদের হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার স্প্রে করতে দেখা যায়। মার্কেটের ভেতর সব বয়সী লোকদের জামা-কাপড় পাওয়া যায়।

পাওয়া যায় কাচের ও বিভিন্ন ধাতু দিয়ে তৈরি থালা-বাসনও। তবে বিভিন্ন পণ্যের দোকান থাকলে এখানে শুধু কাপড়ের দোকানগুলোতে ভিড় লক্ষ করা গেছে। অন্য দোকানগুলোতে তেমন কোনো ভিড় লক্ষ করা যায়নি।

পরিবারসহ এখানে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছিলেন সাদিয়া হোসেন। তার সঙ্গে ছিলেন দুই বোনসহ আরও তিনজন। সবাই একত্রে একটি দোকানে মেয়েদের থ্রিপিস দেখছিলেন। জানতে চাইলে সাদিয়া হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ঈদে কেনাকাটা করতে এসে সামাজিক দূরত্বের কথা চিন্তা করলে চলবে না। আর এত জনসংখ্যার ঘনত্বের এ দেশে কিভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখব। এভাবেই চলতে হবে। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী জালাল মিয়া যুগান্তরকে বলেন, এবারের ঈদে বিক্রি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অনেকেই করোনাভাইরাসের ভয়ে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। এরপরও যাদের প্রয়োজন তারাই আসছেন কেনাকাটা করতে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসায়ের লালবাতি জ্বলে যাবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/307839/