১৫ মে ২০২০, শুক্রবার, ১:১২

দূষণ বাড়ছে সর্বত্রই

করোনায় একমাসে উৎপাদন সাড়ে ১৪ হাজার টন বর্জ্য

বর্জ্যইে বিপন্ন মানব জীবন : ড. আইনুন নিশাত


কোভিড বর্জ্যে সরকার হিমশিম খাচ্ছে : জিয়াউল হক


করোনা প্রাদুর্ভাবে লকডাউনে সারাবিশ্বে পরিবেশ দূষণ কমেছে। পাহাড়-বন-সাগর প্রকৃতি ফিরে পেয়েছে হারানো রঙ। করোনার প্রথম দিকে বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের অন্যতম ঢাকায় বায়ুদূষণ কিছুটা কমে যায়। বুড়িগঙ্গার পানিও ফিরে পায় অক্সিজেন। কিন্তু রাজধানী ঢাকার পরিবেশ এখন ‘যেই লাউ সেই কদু’ অবস্থা। গণপরিবহণ না চললেও মানুষের চলাচল বেড়ে যাওয়ায় দূষণ আরো বেড়ে গেছে।

পলিথিনের অধিক ব্যবহার, মেডিকেল বর্জ্য (ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের খোলস, স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ, সিরাপ), প্লাস্টিক ব্যাগ, ঢাকার আশপাশের ইটভাটা, করোনার কারণে ব্যবহৃত হ্যান্ডগ্লাবস, সার্জিক্যাল হ্যান্ডগ্লাবস, সার্জিক্যাল মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতলের বর্জ্য পানিতে মিশে মারাত্মকভাবে সংক্রমণের বিস্তার ঘটাচ্ছে। এতে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, বালু নদী ছাড়াও ঢাকার ভিতরে ও চারপাশের ডোবা-নালা, মজাপুকুর, ড্রেন সর্বত্রই মারাত্মক দূষণের সৃষ্টি হয়েছে।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, করোনাভাইরাস অনেক নতুন উপলব্ধির জন্ম দিয়েছে। প্রকৃতির রোষানল থেকে বাঁচতে অবশ্যই প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। এই লকডাউনে এটা প্রমাণ হয়েছে যে কি পরিমাণ শিল্প বর্জ্য প্রতিদিন নদীতে মিশে নদীর জীবন কেড়ে নিচ্ছে। যদি নদী না বাঁচে তাহলে বিপন্ন হবে পরিবেশ, বিপন্ন হবে মানব জীবন। কলকারখানার বর্জ্য শোধনাগার অবশ্যই পরিবেশসম্মত আধুনিক করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ রোধে ব্যবহৃত পণ্যবর্জ্য পানিতে মিশে করোনা আরও ভয়াবহ গণসংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দেশে করোনা উপসর্গ ধরা পড়ার পরে শুধুমাত্র একমাসে মাস্ক, হ্যান্ডগøাবসসহ সংশ্লিষ্ট প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৫০০ টন। এই বর্জ্যের মধ্যে শুধু ঢাকায় উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার ৭৬ টন। যার বড় একটি অংশ নদীর পানিতে মিশছে। এতে পানিতে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নদী তীরের শিল্প কারখানা ও অন্যান্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মনিটরিং ও সচেতনতা বাড়াতে পরিবেশ অধিদফতরের নেই কোন কার্যকর তৎপরতা। তাই নদী দূষণ ও সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপ আরও জোরদার করার দাবি বিশেষজ্ঞদের। পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহমদ বলেন, নদীদূষণ প্রতিরোধে আমাদের কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত আছে। মাঠ পর্যায়ে আমাদের পরিদর্শক টিম সব সময় কাজ করছে। তবে করোনার কারণে আমাদের অভিযান বন্ধ রয়েছে।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্যমতে, বুড়িগঙ্গায় প্রতিদিন কলকারখানার ৩৫০০ ঘন মিটার এবং অন্যান্য থেকে ২৭০০ ঘনমিটার দূষিত তরল বর্জ্য মেশে। করোনা মহামারীর কারণে সব কিছু বন্ধ থাকায় এক মাসেরও বেশি সময় নদী এসব দূষণ থেকে মুক্ত ছিল। ফলে প্রাণ ফিরছিল নদীতে। পানিতে বসবাস করা প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য প্রতি লিটারে ৬ মিলিগ্রাম দ্রবীভ‚ত অক্সিজেন দরকার। আতিমাত্রার দূষণে বুড়িগঙ্গায় এর মাত্রা শূন্যে নেমে ছিল। ফলে বুড়িগঙ্গায় মাছ বা অন্য কোনো জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল না।

এই লকডাউনের সময় এক জরিপে দেখা যায় বুড়িগঙ্গায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৫ মিলিগ্রামের কাছাকাছি। এতে মাছ-অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তবে লকডাউন শিথিলের পর নদীতে আবারও মিশছে কলকারখানাসহ অন্যান্য বর্জ্য, দূষিত হচ্ছে পানি। এ ছাড়া এসডোর গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত এক মাসে সারা দেশে পলিথিন ব্যাগের বর্জ্য ৫ হাজার ৭৯৬ টন, পলিথিন হ্যান্ডগøাবস ৩ হাজার ৩৯ টন, সার্জিক্যাল হ্যান্ডগøাভস ২ হাজার ৮৩৮ টন, সার্জিক্যাল মাস্ক এক হাজার ৫৯২ টন ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ৯০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। এ সময়ে শুধু ঢাকায়ই সর্বোচ্চ এক হাজার ৩১৪ টন সার্জিক্যাল হ্যান্ড গøাবসের বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। পলিথিন হ্যান্ডগøাভস ৬০২ টন, সার্জিক্যাল মাস্ক ৪৪৭ টন, পলিথিন ব্যাগ ৪৪৩ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ২৭০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে। এসব বর্জ্য পানিতে মিশে মারাত্মকভাবে সংক্রমণের বিস্তার ঘটাতে পারে।

পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (বায়ুমান) জিয়াউল হক বলেন, কভিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের সংস্থাগুলো হিমশিম খাচ্ছে। তবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর। যত্রতত্র এসব আবর্জনা না ফেলে জনগণকে সহযোগিতা করতে হবে। তা না হলে এটি আরও কঠিন হবে। সদরঘাট থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত নদীর দুই পাশ থেকেই অনবরত ফেলা হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্য। কলকারখানার বর্জ্যে দূষণে বুড়িগঙ্গা প্রাণহীন হয়ে পড়ে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, রাজধানীবাসীর পয়োবর্জ্য ও গৃহস্থালী বর্জ্য, এবং ৬২ ধরণের রাসায়নিক বর্জ্যে অনেক আগেই বিষাক্ত হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি। বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে পলিথিনের স্তর। নদীটির পানিতে অ্যান্টিবায়োটিকসহ হাসপাতালের বর্জ্য মিশছে। এমেক্সাসিলিন, পেনিসিলিন আর অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মতো উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়েটিকও রয়েছে এর মধ্যে। এ ছাড়া এর সাথে যুক্ত হচ্ছে করোনাকালীন সৃষ্ট বিভিন্ন বর্জ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের খোলস, স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ, সিরাপ এবং হ্যান্ডগøাবস, মাস্ক ইত্যাদি হাসপাতাল-বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। এ কারণেই অ্যান্টিবায়োটিক পানিতে মিশছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভ‚ত অক্সিজেন অনেক কমে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে পানির গুণাগুণ। ঢাকার চারপাশে ছোট বড় সব শিল্প কলকারখানা খুলে দেয়ায় মেঘনা, শীতলক্ষ্যাসহ শাখা নদীর পানিতে মিশছে দূষিত ও বিষাক্ত বর্জ্য। নদ-নদী ও খাল প্রভাবশালী এবং বিভিন্ন শিল্প কারখানার মালিকরা দখল করে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে দূষিত করায় হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত গত বছর মে মাসে বুড়িগঙ্গার ভেতরে যে সমস্ত স্যুয়ারেজ লাইন আছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্যরে লাইন আছে সেগুলো ছয় মাসের মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল। এর পাশাপাশি বুড়িগঙ্গার তীরে যাতে ময়লা আবর্জনা ফেলতে না পারে সেজন্য সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করার জন্য রায়ে বলা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এই নির্দেশনাগুলো পুরোপুরি পালন না করায় বুড়িগঙ্গার পানির দূষণ অব্যাহত রয়েছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/291897