১০ মে ২০২০, রবিবার, ৫:০৩

জেলা হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুসন্ধান

অক্সিজেন সরবরাহের সরঞ্জাম সংকট

প্রস্তুত নয় জেলা হাসপাতালগুলো: ৯০ ভাগ হাসপাতালে নেই কনসেনট্রেটর, বিপাপ ও সিপাপ * অক্সিজেন মাস্কের ঘাটতি রয়েছে ৩০ শতাংশ হাসপাতালে * পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ রয়েছে -মহাপরিচালক

দেশের বিভিন্ন জেলায় করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন দেয়ার মতো সরঞ্জামের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে রোগীর সেবা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতালে সিলিন্ডার থাকলেও রোগীদের জন্য অক্সিজেন সরবরাহে প্রয়োজনীয় সুবিধা নেই। ৯০ শতাংশ জেলা হাসপাতালে নেই এবিজি (আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইজার) মেশিন।

অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও ৮৯ শতাংশ হাসপাতালে নেই অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। ৯৫ ভাগ হাসপাতালে নেই বিপাপ ও সিপাপ (প্রেসার দিয়ে ফুসফুসে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করার যন্ত্র)। এমনকি অক্সিজেন মাস্কের ঘটতি রয়েছে ৩০ শতাংশ হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।

সম্প্রতি জেলা পর্যায়ে কোভিড-১৯ হাসপাতালগুলোতে রোগীদের অক্সিজেন সুবিধা নিশ্চিতে কোনো ঘাটতি আছে কিনা তার অনুসন্ধান চালায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতালে শাখা। সেখানে এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। অথচ করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় অক্সিজেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাভাইরাসের মুমূর্ষু রোগীদের প্রধান জটিলতা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা। এ সমস্যার প্রাথমিক সমাধান হিসেবে রোগীকে চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সরবরাহ করতে হবে। এতেই বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে উঠেবেন। এক্ষেত্রে কারও কারও বেলায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন পড়তে পারে। ফলে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ, এ সংক্রান্ত সরঞ্জাম ও এর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার সংগৃহীত সর্বশেষ তথ্য দেখা গেছে, দেশের ৫৭টি জেলা হাসপাতালে অক্সিজেন টিউব আছে। মাত্র ১০ শতাংশ হাসপাতালে আছে এবিজি (আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইজার)। দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে পালস অক্সিমিটার রয়েছে। সব জেলা হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলে মাত্র ১০ শতাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে। দেশের ৫৩ শতাংশ হাসপাতালে নেজাল ক্যানোলা এবং দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে। মাত্র ৫ শতাংশ হাসপাতালে বিপিএপি এবং সিপিএপি আছে। মাত্র ১৪ শতাংশ হাসপাতালে মেকানিক্যাল (কারিগরি) ভেন্টিলেটর রয়েছে।

এছাড়া দেশের ৫৮টি জেলার মধ্যে ১৬টি জেলা হাসপাতালের কোনো বিভাগে একটিও পালস অক্সিমিটার মেশিন নেই। মাত্র ৬টি হাসপাতালের বহির্বিভাগে পালস অক্সিমিটার আছে। মাত্র ৯টি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক বিভাগে, ৫টি জেলা হাসপাতালের সাধারণ বিভাগে, ৩১টি জেলা হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে, ৩টি জেলা হাসপাতালের আইসিইউতে পালস অক্সিমিটার মেশিন রয়েছে।

অক্সিজেন সংক্রান্ত নতুন এ তালিকায় দেখা গেছে, দেশের ৩৭টি জেলা হাসপাতালের কোনো না কোনো বিভাগে পালস অক্সিমিটার রয়েছে, মাত্র ৪টি জেলা হাসপাতালে আছে এজিবি মেশিন, কনসেনট্রেটর মেশিন রয়েছে মাত্র ৭টি হাসপাতালে। অক্সিজেন ব্যবহারের জন্য ফেসমাস্ক রয়েছে ৩৭টি হাসপাতালে। হিউমডিফায়ার রয়েছে ৪৮টি হাসপাতালে, সিপ্যাপ রয়েছে ৪টি এবং বিপ্যাপ রয়েছে মাত্র ৩টি হাসপাতালে। এছাড়া এন্ড্রোটিক্যাল টিউব রয়েছে ৩৩টি হাসপাতালে এবং ভেন্টিলেটর রয়েছে ৮টি হাসপাতালে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, পালস অক্সিমিটার দিয়ে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের ঘটতির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। সেই অনুযায়ী রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। এজিবি বা আর্টারিয়ান ব্লাড হ্যাস এনালাইজার দিয়ে মুমূর্ষু রোগীর শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। কনসেনট্রেটর মেশিন বাতাসের নাইট্রোজেন সরিয়ে অক্সিজেনের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে। ক্যানোলা অক্সিজেন সিলেন্ডার ও ফেসমাস্কের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। হিউমডিফায়ার মূলত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের মধ্যে থেকে বাতাসের আর্দ্রতা নিষ্কাশন করে থাকে। যাতে সেখানকার রোগীরা রোগ জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত না হন। সিপ্যাপ ও বিপ্যাপ মূলত যেখানে ভেন্টিলেটর মেশিন না থাকে সেখানে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের চাপ নিশ্চিত করতে ব্যবহার হয়। যাতে রোগীর ফুসফুসে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন পৌঁছায় এবং ফুসফুস কলাপস না করে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, আমার জানামতে, রাজধানীসহ জেলা হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুদ রয়েছে। এছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই হাসপাতাগুলোতে অক্সিজেনের কোনো ঘটতি নেই। কিছু এক্সেসরিজের ঘাটতি থাকলে সেগুলোর ব্যবস্থা করা হবে। এতে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে না বলে মনে করেন তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় বলা আছে, হাসপাতালগুলোয় করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এছাড়া হাসপাতালগুলোকে ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী ও কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর স্বল্পতা আছে। ভেন্টিলেশন, আইসিইউর ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩টি হাসপাতালে ৫৫টি আইসিইউ শয্যা থাকলেও এসব আইসিইউ পরিচালনায় বা রোগীদের পরিচর্যায় নেই প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা নার্স।

অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এ মুহূর্তে দেশে ১ হাজার ৫০টি আইসোলেশন বেড থাকলেও আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৫০টির মতো। যদিও এর সবক’টিতে নেই ভেন্টিলেটর সুবিধা। চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা রোগীদের মধ্যে প্রায় ১৮ শতাংশ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত থাকায় আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ৯ মে পর্যন্ত করোনা সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ২১৪ জন। শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার ৭৭০ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে যুক্ত হয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা শনিবার দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এ সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সারা দেশে এখন আইসোলেশন শয্যা আছে ৮ হাজার ৬৩৪টি। নতুন করে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪০টি আইসোলেশন শয্যা বেড়েছে। এছাড়া ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০০টি ও কলেজের নার্সিং ডরমেটরিতে আরও ২০০টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করা হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/305669/