৭ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ২:৫৮

গৌরীপুরে ১০ টাকা কেজির চাল: নিয়মিত উত্তোলন, চার বছরেও পাননি দরিদ্ররা

ময়মনসিংহের গৌরীপুরে মাওহা ইউনিয়নে তালিকায় নাম থাকলেও ৪ বছরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল পাননি কয়েকশ’ দরিদ্র মানুষ। এদের মধ্যে ১৫১ জন তাদের নামে বরাদ্দ দেয়া চাল লুটের অভিযোগ তুলে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে দোষীদের বিচার দাবি করেছেন।

ঘটনা তদন্তে মঙ্গলবার তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। যুগান্তরকে বুধবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইউএনও সেঁজুতি ধর।

এ ইউনিয়নে ১ হাজার ৯৪৭ সুবিধাভোগীর মধ্যে (জনপ্রতি ৩০ কেজি করে) বিতরণের জন্য তিন ডিলার প্রতি মাসে ৫৮ দশমিক ৪১ টন চাল বরাদ্দ পেয়ে আসছেন। সেই হিসাবে ৪ বছরে প্রায় ২ হাজার ৮০০ টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন তারা।

স্থানীয়রা বলছেন, এর অধিকাংশই সুবিধাভোগীরা পাননি। যে দেড়শ’ ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন শুধু তারাই বঞ্চিত হয়েছেন ২১৭ টন চাল। অভিযোগ উঠেছে, চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সঙ্গে যোগসাজশে ডিলাররা তা বাইরে বিক্রি করে দিয়েছেন।

এর আগে ২০ এপ্রিল পুলিশ চাল ব্যবসায়ী ফজল মুন্সীর ঘর থেকে ৬৭ বস্তা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৩ হাজার ৩৫০ কেজি চাল জব্দ করে। আরেক ব্যবসায়ী আজাহারুল ইসলামের ঘর থেকে ১ হাজার ২৫০ কেজি চাল জব্দ করে ও তাকে গ্রেফতার করে।

এ ঘটনায় দুটি মামলা করেন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা বিপ্লব সরকার। স্থানীয়রা বলছেন, বিষয়টি জনগণের আড়ালে নিতে এবং ডিলার ও ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে লকডাউন ভেঙে ২১ এপ্রিল নহাটা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিশাল গণজমায়েত করা হয়।

এক অভিযোগপত্রে ১০৯ জন (স্বাক্ষর ৯২ জনের) ও দ্বিতীয় অভিযোগপত্রে ৪২ জন কার্ডধারী অভিযোগ করেন। এদের একজন ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল বাশার জানান, ‘আমার নামে কার্ড আছে, চাল পাইনি। ডিলারের দোকানে গেলে বলে, চেয়ারম্যান-মেম্বারের সঙ্গে যোগাযোগ কর; তাদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আমি ক্লান্ত।’

চাল না পাওয়ার অভিযোগ করেন আবদুল হেলিম (কার্ড নং ১৭৮০), তাতিরপয়া গ্রামের আবু ছালাম (১৭৭৮), হালেমা খাতুন (১৭৮১), আবু ছিদ্দিক (১৭৮৩), আমেনা খাতুন (৩৪৯) ও কাঞ্চন মিয়া (১৭৮৬)।

কাঞ্চন মিয়ার ভাই আবদুস সামাদ জানান, এক মাসে দিয়েছিল, এরপর আর দেয়নি। রামকৃষ্ণপুরের রোকসানা আক্তার (১০৩৫), রেনু আক্তার (১০৩৮), রাবিয়া খাতুন (১০৪৬), নুরবানু (৯১২), শহরবানু (১০২০), আনোয়ারা খাতুন (১০১৩), আবদুল ছোবান (১০০৬), আবদুল রহমান (১০০৮), জহুরা খাতুনসহ (১০২৬) কয়েকজন জানান, কার্ড করার জন্য মেম্বার তাদের কাছ থেকে ভোটার আইডি, ছবি ইত্যাদি নিয়েছিলেন।

মাওহা বড়ইকান্দা গ্রামের মৃত আবদুল মোতালিবের স্ত্রী সুফিয়া খাতুন ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তার নামে রয়েছে ১০ টাকা কেজির কার্ড। তিনি বলেন, আমার নামের চাল যারা চার বছর ধরে তুলে নিয়েছে, আল্লাহ যেন তাদের আমার চেয়েও খারাপ অবস্থা করে!

৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার আবুল মিয়ার বিরুদ্ধে বিষমপুর গ্রামবাসীর অভিযোগ, এ গ্রামে ৬৭ জনের নামে কার্ড রয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জন এ গ্রামের বাসিন্দা নয়, ভুয়া ব্যক্তি। তালিকাভুক্ত আতিকুর রহমান (৮৬৩), রুবেল (৮৭২), জারবানু (৮৫৫), হেলানা খাতুন (৮১২), কলিম উদ্দিন (৮৫৬), আছিয়া খাতুন (৮৬৫), রুক্তন (৮৪৭), নয়ন মিয়া (৮৪১), সাইদুল (৮২৬), আছিয়া খাতুন (৮৫০) অভিযোগ করেন, চার বছরে কখনই তারা চাল পাননি। বরং মেম্বারের স্ত্রী শিল্পী বেগমের নামে কার্ড রয়েছে, তিনি নিয়মিত চাল তুলছেনও।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল মিয়া যুগান্তরকে বলেন, আমি দরিদ্র মানুষ, এ জন্যই স্ত্রীর নামে কার্ড করেছি। কার্ডধারী অন্যরা চাল পেয়েছেন কিনা আমি জানি না। জানতে চাইলে মাওহা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রমিজ উদ্দিন স্বপন বুধবার যুগান্তরকে বলেন, কার্ডের চালের প্রসঙ্গে এ মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারব না।

নহাটা বাজারের ডিলার মাসুদ করিম রুবেল জানান, কার্ডের বিষয়টি চেয়ারম্যান-মেম্বার বলতে পারবেন। আমার এখানে প্রতি মাসে ৬৮৩ জন কার্ড নিয়ে এসেই চাল নিয়ে গেছেন।

ডিলার আবদুল জব্বার জানান, আমার কাছে ৬৪৪ জন উপকারভোগীর তালিকা রয়েছে, সবাই চাল নিয়ে যাচ্ছেন। কার্ডধারী নকল না আসল তা আমি বলতে পারব না।

আরেক ডিলার আজিজুল হক ইনসান জানান, তিনি ৬২০ জনকে চাল দিয়েছেন। চাল আÍসাতের অভিযোগ ঠিক নয়। তিনি বলেন, দু’চার কার্ডের নামে সমস্যা থাকতে পারে, সেটা মেম্বার বলতে পারবেন।

ইউএনও সেঁজুতি ধর বলেন, উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসার নন্দন কুমার দেবনাথকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেন - উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার মোহাম্মদ উল্লাহ পারভেজ ও উপজেলা জনস্বাস্থ্য উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আবদুল মান্নান। নন্দন কুমার দেবনাথ বলেন, তদন্ত করে দ্রুতই প্রতিবেদন দেয়া হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/304927/