৬ মে ২০২০, বুধবার, ২:৩২

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বেহাল দশা

চিকিৎসা না পেয়ে ক্যান্সার রোগী ফিরে যাচ্ছেন

দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত রমজান আলী। বৃহস্পতিবার রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে স্ত্রী রহিমা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। কেমোথেরাপির বিশেষ প্রয়োজন ছিল তার।

কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। অবশেষে চিকিৎসা না পেয়েই তাকে ফেরত যেতে হয়েছে।

শুধু রমজান আলী নন, তার মতো আরও অনেক রোগী চিকিৎসা সেবা না পেয়ে এ হাসপাতাল থেকে ফেরত যাচ্ছেন। রোগীরা যেমন চিকিৎসা পেতে চাইছেন, তেমনি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতায় মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অভিযোগ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শিতা ও সিদ্ধান্তহীনতায় এমন

ঘটনা ঘটছে। চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও নার্সরা পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী পাচ্ছেন না।

জানতে চাইলে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মামুন মোর্শেদ যুগান্তরকে বলেন, এ হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা হচ্ছে না। অন্য রোগীদের ভর্তি ও জরুরি অপারেশন করা হচ্ছে। ভর্তিযোগ্য সব রোগীই ভর্তি হচ্ছেন। আউটডোর ও ইমারজেন্সি চালু রয়েছে। তবে কিছু পরীক্ষা করা যাচ্ছে না।

রেডিওলজি ও প্যাথলজি বিভাগের বিপুলসংখ্যক টেকনিশিয়ান এবং চিকিৎসকের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেকের নমুনা পরীক্ষা করা হলেও সব রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।

এখন পর্যন্ত ৫৪ জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে চিকিৎসক ৩৪, নার্স ৭ ও ১৩ জন হেলথ ওয়ার্কার। তবে যাদের করোনা নেগেটিভ হবে তাদের দিয়ে কাজ চালানো হবে। তিনি বলেন, আমরা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী পেয়েছি। হাসপাতালের ২৮টি ডিপার্টমেন্ট আগের মতোই চলছে। তিনি বলেন, হাসপাতালের দুটি অ্যাম্বুলেন্সের দু’জন চালকেরই করোনা পজিটিভ।

ফলে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস বন্ধ রয়েছে। আবার হাসপাতালের রোগীর সংখ্যাও আগের চেয়ে বহুগুণে কমে গেছে। আমরা আমাদের যথাসাধ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছি। বর্তমান পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স অথবা কোনো স্টাফ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে হাসপাতালের তিন নম্বর ওয়ার্ডে তাদের চিকিৎসা দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

বিষয়টি লিখিত আকারে না হলেও হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য সব স্টাফের জানা। সরেজমিন জানা গেছে, হাসপাতালের তিন নম্বর ওয়ার্ডটি সবচেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক। এখানেই মূলত ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। ওয়ার্ডটিতে সেন্ট্রাল এসি রয়েছে। তুর্কি সরকারের অর্থায়নে ওয়ার্ডটি নির্মাণ করা হয়। দুই বছর ওয়ার্ডটির রক্ষণাবেক্ষণের পর তুর্কি সরকার সেটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে।

ক্যান্সার রোগীদের এ ওয়ার্ডে করোনা রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলেও ক্যান্সার রোগীদের কোথায় রাখা হবে সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ফলে জরুরি প্রয়োজনেও ক্যান্সার রোগীদের এখানে ভর্তি করা যাচ্ছে না।

একজন ক্যান্সার রোগ বিশেষজ্ঞ যুগান্তরকে বলেন, ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা মূলত একটি স্পেশাল সাবজেক্ট। যে কোনো জায়গায় মন চাইলেই চিকিৎসাটি দেয়া যায় না। অনেকগুলো স্যালাইন লাগে, নির্দিষ্ট সময় ধরে দিতে হয়, নির্দিষ্ট সময় পরপর তা পরিবর্তন করতে হয়। এসবের একটু ব্যতিক্রম ঘটলে এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে যে একজন মানুষের অঙ্গহানি ঘটতে পারে।

এদিকে, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে তিন নম্বর ওয়ার্ডের নার্সদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তিন নম্বর ওয়ার্ডে করোনা রোগী ভর্তি হলে সেবা দিতে তারা অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এর পেছনে তারা দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন- প্রথমত, এটি করোনা হাসপাতাল নয়। দ্বিতীয়ত, নার্সদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা সামগ্রী নেই। টানা ৭ দিন ডিউটি করার পর দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এটি মানতে নারাজ।

কর্তৃপক্ষের বলছে, ডিউটি করে বাসায় চলে যেতে। ফলে নার্সরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি হলেও পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাইছেন না।

তিন নম্বর ওয়ার্ডের এক নার্স যুগান্তরকে বলেন, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে রাজি আছি। এতে কোনো সমস্যা নেই। করোনা রোগীর সেবা করে পৃথক না থেকে আমরা বাড়ি গিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারি না।

এ নিয়ে হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলেন, আমরা অসুস্থ (করোনায় আক্রান্ত) হলে আমাদের চিকিৎসা আমরাই করব। আর নার্সদের কিছু হলে তাদের চিকিৎসা তারা করবে। এ নিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে বেশ রেষারেষি চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/304632