৬ মে ২০২০, বুধবার, ২:২৭

করোনায় অসহায় পরিবহন শ্রমিকদের আর্তনাদ

চাঁদার টাকা যায় কোথায়

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ফান্ডে পরিবহন শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য জমা আছে প্রায় পাঁচশ’ কোটি টাকা। শুধু শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনেরই রয়েছে চারশ’ কোটি টাকার বেশি।

স্বীকৃত (অফিসিয়াল) এই মোট অঙ্কের টাকার বাইরেও বিভিন্ন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে বৈধ ও অবৈধভাবে তোলা হয়েছে কয়েকশ’ কোটি টাকা। অথচ করোনাভাইরাস সংকটে এসব তহবিল থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না শ্রমিকরা। রাজধানীর মহাখালী ছাড়া বাকি বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক পরিবহন শ্রমিকদের আর্থিক সহযোগিতা করেননি মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা।

এমনকি সহযোগিতা করার ভয়ে অনেক নেতা টার্মিনালেও যাচ্ছেন না। এসব নেতাকে এখনই চিনে রাখার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন স্তরের শ্রমিকরা। তাদের মতে, ভবিষ্যতে এসব ব্যক্তি যাতে নেতৃত্বে আসতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।

শুধু তাই নয়, রাজধানীর পরিবহন শ্রমিকরা এখন পর্যন্ত পাননি সরকারি ত্রাণও। এমন পরিস্থিতিতে টাকার অভাবে অর্ধাহারে ও অনাহারে থাকা শ্রমিকদের প্রশ্ন চাঁদার টাকা গেল কোথায়। যদিও টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করছেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

আরও জানা গেছে, শ্রমিকদের সহযোগিতার জন্য মূলত তিনটি খাত রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর শ্রমিক কল্যাণ তহবিল। এই তিন তহবিলের বাইরে বিভিন্ন সংগঠনের নামে অবৈধভাবে বাসপ্রতি স্থানভেদে দৈনিক ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে।

কোথাও চাঁদার পরিমাণ আরও বেশি। একইভাবে ট্রাক ও অন্যান্য গণপরিবহন থেকেও নেয়া হয়েছে চাঁদা। টার্মিনালভিত্তিক কমিটি দখল-পাল্টা দখলের কারসাজিতে ওই টাকা ভাগবাটোয়ারা ও আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, সায়েদাবাদ ও ফুলবাড়িয়াসহ বেশ কয়েকটি টার্মিনালের পরিবহন নেতারা শ্রম কল্যাণ ফান্ডের বৈধ টাকাও আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

পরিবহন খাতের চাঁদার টাকা চারটি মহলে ভাগবাটোয়ারা করায় শ্রমিকরা আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, যখন গাড়ি সচল ছিল তখন রাজধানীতে বাসপ্রতি দৈনিক ৮০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত, আন্তঃজেলার বাস থেকে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। এছাড়া গ্রামগঞ্জে ও পাড়ামহল্লার অটোরিকশা থেকে দৈনিক দু’শ টাকার বেশি চাঁদা আদায় করা হয়। এভাবে দৈনিক চাঁদা আদায় হলেও শ্রমিকরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছে। এর কারণ হচ্ছে, চাঁদার এসব টাকা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কিছু প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার পকেটে যাচ্ছে। এ কারণে করোনাভাইরাসের মতো বৈশ্বিক সমস্যার সময়ে শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী যুগান্তরকে বলেন, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে প্রতিদিন ৭০ টাকা আদায় করা হয়। এর বাইরেও কিছু টাকা আদায় হয়- তা অস্বীকার করা যাবে না। ঢাকায় আদায় করা ওই টাকার সবই চলে যায় মালিক সংগঠনের পকেটে।

এমনকি শ্রমিক ইউনিয়নগুলো মালিক সমিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ঢাকার বাইরের শ্রমিক ইউনিয়নের ফান্ডে খুব একটা টাকা থাকে না। যে টাকা থাকে তা দিয়ে দুর্ঘটনা বা মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকের পরিবারকে সহযোগিতা করা হয়। করোনাভাইরাসে শ্রমিকদের খুব একটা সহযোগিতা করা যাচ্ছে না।

শ্রমিক ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ অস্বীকার করে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। তিনি বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার শ্রমিকদের সহযোগিতা করেছি, অন্য মালিকদের বলেছি তাদের শ্রমিকদের সহযোগিতা করতে। যারা চাঁদার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে কথা বলে তারা কী করেছে। একটি ফেডারেশন প্রতি মাসে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো হাজার থেকে লাখ পর্যন্ত চাঁদা নিচ্ছে। সেগুলো শ্রমিকদের পেছনে ব্যয় করে না কেন?

জানা গেছে, বর্তমানে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে ৪১০ কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে। এ ফাউন্ডেশনের নীতিমালায় অসুস্থ বা মারা গেলে শ্রমিকদের সহযোগিতার বিধান রয়েছে। করোনাভাইরাসের মতো মহামারীতে সহযোগিতার বিধান নেই।

এ কারণে ওই ফাউন্ডেশন থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মো. রেজাউল হক যুগান্তরকে বলেন, আমরা নীতিমালার বাইরে যেতে পারি না। রোগাক্রান্ত, দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত শ্রমিকের পরিবারকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়। কিন্তু নীতিমালায় করোনাভাইরাসে কর্মহীন শ্রমিকদের অর্থ সহযোগিতা দেয়ার সুযোগ নেই।

আরও জানা গেছে, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল অনেক বছর আগে গঠিত হলেও তা এখনও কার্যকর হয়নি। ওই তহবিল খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় এক কোটি টাকা অনুদান দেন। ওই টাকাই সুদে আসলে এক কোটি ৩০ লাখের মতো দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তহবিলের প্রধান কে হবেন- সেই দ্বন্দ্বে এ তহবিল কার্যকর হয়নি। অপরদিকে শ্রমিকদের থেকে নিয়মিত টাকা নিলেও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর তহবিলে হরিলুট চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফুলবাড়িয়া টার্মিনালকেন্দ্রিক শ্রমিক সংগঠন ঢাকা জেলা যানবাহন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের আওতায় ছয় হাজারের বেশি শ্রমিক রয়েছে। এসব শ্রমিক থেকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা আদায় করে আসছে এ সংগঠন।

অথচ করোনার কারণে গাড়ি লকডাউন থাকায় বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকদের কোনো আর্থিক সহযোগিতা করেনি এ সংগঠনটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক বলেন, শ্রমিক ও মালিক সংগঠন থেকে তাদের আর্থিক সহযোগিতা দেয়নি। যখন সচল ছিল তখন প্রতিদিন প্রতিটি গাড়ি থেকে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা চাঁদা দিতাম। আবার মাস শেষেও শ্রমিক সংগঠনকে চাঁদা দিয়ে গাড়ি চালিয়েছি।

এভাবে প্রতিদিন যে লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা উঠেছে সেই টাকা গেল কোথায়? জানতে চাইলে এ টার্মিনালকেন্দ্রিক পরিবহন শ্রমিক সংগঠন ঢাকা জেলা যানবাহন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল আমিন নুরুর কাছে শ্রমিক কল্যাণ ফান্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের কমিটি ওই ফান্ড বিলুপ্ত করে দিয়েছে। কিছু নেতা ওই ফান্ডের টাকা আÍসাৎ করেছে। এখন ফান্ড নেই। তবে যেটুকু জমা হয়েছে তা দুর্ঘটনার শিকার শ্রমিকদের দিয়েছি। এখন গাড়ি বন্ধ থাকায় ধান্ধা-ফিকির নেই।

রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক শ্রমিক ইউনিয়নেও রয়েছে ছয় হাজারের মতো সদস্য। এ টার্মিনালে শ্রমিক ইউনিয়নের নামে কমিটি দখল-পাল্টা দখলের ঘটনা ঘটেছে।

নতুন কমিটি আসার পরও চাঁদা আদায় হলেও শ্রমিক ইউনিয়নের কল্যাণ ফান্ড শূন্য। সায়েদাবাদ শ্রমিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কাজী সেলিম সরওয়ার বলেন, কল্যাণ ফান্ডে কোনো টাকা নেই। আমরা প্রতিটি শ্রমিক থেকে মাসে ২০ টাকা হারে চাঁদা নেই। সেই টাকা থেকে মারা যাওয়া শ্রমিক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা হারে দিয়েছি। গত এক বছরে ১২-১৩ জন শ্রমিক মারা গেছে। তাদের পরিবারে টাকা দেয়ায় তা শেষ হয়ে গেছে।

অপরদিকে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে, রাজধানীর মহাখালী টার্মিনালে। এ টার্মিনালের শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের উদ্যোগে দুই-তিন দফায় শ্রমিকদের খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে সদস্যদের টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এ টার্মিনালকেন্দ্রিক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সাদেকুর রহমান হিরু বলেন, আমরা সরকারি কোনো ত্রাণ পাইনি। জেলা প্রশাসকের কাছে তালিকা জমা দিলে সেখানে বরাদ্দ নেই বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকেও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

অপরদিকে বাংলাদেশ আন্তঃজেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. তাজুল জানান, তার সংগঠনের অধীনে একশ’র বেশি শাখা ইউনিয়ন রয়েছে। শাখা অফিসগুলো প্রতিটি গাড়ি থেকে ২০ টাকা হারে তোলে। প্রতি মাসে প্রতিটি শাখা অফিস কেন্দ্রীয় অফিসকে দুই হাজার টাকা জমা দেয়। ওই টাকায় সংগঠন পরিচালিত হয়। আমাদের তেমন ফান্ড না থাকায় শ্রমিকদের সহযোগিতা করতে পারছি না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/304616