৩ মে ২০২০, রবিবার, ৬:১৪

নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান

করোনায় তারল্য সংকট প্রকটের আশঙ্কা

বিপাকে পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারীরা * বিশেষ তহবিল চায় বিএলএফসিএ

দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক সংকটে ভুগছে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানিগুলো। করোনাভাইরাসের প্রভাবে সে সংকট আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তা লাগবে।

খাতটিকে সচল এবং তারল্য সংকট দূর করতে একটি বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে। শিগগিরই তহবিল গঠনের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) সভাপতি ও আইপিডিসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, লিজিং খাত একটি সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।

সেটা করোনাভাইরাসের কারণে আরও প্রকট হল। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারল্য সংকট মোকাবেলায় একটি বিশেষ তহবিল গঠনের অনুরোধ জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে আমরা আজ-কালের মধ্যেই সুনির্দিষ্ট একটি সুপারিশ পাঠাব।

বিএলএফসিএর সাবেক সভাপতি ও ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. খলিলুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, করোনাভাইরাসের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে সীমিত লেনদেন চলছে।

তবে আমরা চিন্তিত, তারল্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।

সূত্র জানায়, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে লিজিং কোম্পানিগুলো প্রায় ধ্বংসের পথে। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকি সব নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তারল্য সংকটে ভুগছে। ৬ থেকে ৭টি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খুবই নাজুক।

এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে নেমে এলো করোনার আঘাত। সে কারণে অধিকাংশ শীর্ষ নির্বাহী চিন্তিত।

নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতেগোনা যে কয়েকটি ভালো, তার একটি হল আইডিএলসি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন মো. আরিফ খান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, করোনার মধ্যেও আইডিএলসি নিয়ম মেনে সীমিত আকারে কাজ করছে।

বেশ কিছু সেবা অনলাইনের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। আইডিএলসির তারল্য পরিস্থিতি ভালো। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিষ্ঠান বেশি চাপে থাকবে। এ ধরনের চাপে যে শুধু নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান পড়বে তা নয়, অনেক দুর্বল ব্যাংকও একই পরিণতি ভোগ করবে।

তা ছাড়া সবল প্রতিষ্ঠানও হিমশিম খাবে। কারণ প্রায় ৬ মাস ঋণ দেয়া এবং বন্ধ রয়েছে। এ বন্ধ আরও লম্বা হতে পারে। সুতরাং তারল্য সংকটের কমবেশি চাপ সবার ওপর পড়বে।

জানা গেছে, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে থমকে পড়েছে স্বাভাবিক কার্যক্রম। বন্ধ হয়ে গেছে বেশিরভাগ পণ্যের আমদানি-রফতানি। ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি।

আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশসহ প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে আরও অনেক দেশ। বৃহৎ ও ক্ষুদ্র্রশিল্প, রফতানিমুখী শিল্প, পোশাক খাত, মাঝারি উদ্যোক্তা ও কৃষি খাতকে স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সহযোগিতা করছে সরকার।

কিন্তু বিপাকে পড়েছেন লুটপাটের শিকার নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) আমানতকারীরা। অবসায়ন ঘোষণার পর অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

অন্যদিকে টাকা হারিয়ে আমানতকারীরা দিশেহারা হয়ে ঘুরছেন। চলমান ক্রান্তিকালে প্রণোদনার মাধ্যমে হলেও সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুকে’ ছড়িয়ে পড়া একটি পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তারা বলেন, আপনি প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা দেশের মানুষের কল্যাণে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে বাঁচার প্রেরণা দিয়েছেন, সেখানে আমাদের আমানতকারীদের আমানত অতি সামান্য।

এমতাবস্থায় আপনিই আমাদের আমানতকৃত অর্থ ফিরে পাওয়ার একটা সুব্যবস্থা করে বাঁচার উপায় বের করে দিতে পারেন। আপনি অত্যন্ত দয়াবান ও অসহায়ের সহায়।

করোনা মহামারীর এ পরম ক্রান্তিলগ্নে আপনি দুর্গত সবাইকে সাহায্য করছেন; একইভাবে দয়া করে আমাদের দিকেও যদি আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। তাই আপনার কাছে আমাদের হাতজোড় মিনতি, আমাদের বাঁচাতে সাহায্য করুন।

এর আগে আমানত ফিরে পেতে অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গেও দেখা করেছেন পিএলএফএসএলের আমানতকারীরা। তাৎক্ষণিকভাবে আমানত ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

তাই আদৌ টাকা ফেরত পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৬ হাজার আমানতকারী।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ের গত ৫ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সেই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে হাইকোর্টে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে হাইকোর্ট থেকে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটের কারণে পিপলস লিজিংকে প্রথমবারের মতো অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের (২০১৯) ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের আবেদন করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৬ জুন অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দেয়। ১০ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক অবসায়নের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করে।

এছাড়া অনিয়মের দায়ে বহিষ্কার করা হয় প্রতিষ্ঠানের নয় পরিচালককে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে আসে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে ৫৭০ কোটি টাকা বের করে নেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা।

অবসায়নের পর এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়- পিপলস লিজিংয়ের মোট আমানত ২ হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে।

বাকি ৭০০ কোটি টাকা ৬ হাজার ব্যক্তি শ্রেণির আমানত। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪৮ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের বড় অংশই নিয়েছে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।

ধারাবাহিকভাবে লোকসানের কারণে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি লভ্যাংশ দিতে পারছিল না। ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পায়। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/303674