ছবি: সংগৃহীত
২৭ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ৪:১৯

সীমিত আকারে গার্মেন্ট চালু সারা দেশে

কারখানা খোলার তথ্য নিয়ে বিজিএমইএর লুকোচুরি * ১ হাজার ৪২৭ কারখানা খোলা হয়েছে : শিল্প পুলিশ

সারা দেশেই সীমিত আকারে পোশাক কারখানা খুলেছে। যদিও বিজিএমইএ শুধু ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে কারখানা খোলার নির্দেশনা দিয়েছিল এবং কোন ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে হবে- এর একটি গাইডলাইন দেয় মালিকদের।

কিন্তু গার্মেন্ট মালিকরা বিজিএমইএর নির্দেশ না মেনে রোববার গাজীপুর, টঙ্গী, সাভারে কারখানা চালু করেন। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা মানা হয়নি। ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি করে শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশ করতে দেখা গেছে।

এছাড়া এদিন ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় মার্চের বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধও করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রোববার শ্রম প্রতিমন্ত্রীর বাসায় জরুরি বৈঠক করেন পোশাক খাতের শীর্ষ নেতারা।

আর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর (ডিআইএফই) বলছে, আন্তর্জাতিক মান পর্যালোচনা করে আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে গাইডলাইন দেয়া হবে। সে অনুযায়ী কারখানা চালাতে হবে।

অন্যদিকে সারা দেশে প্রথম দিনে কতটি গার্মেন্ট খোলা হয়েছে, এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য বিজিএমইএ জানায়নি। তবে শিল্প পুলিশের তথ্যমতে, সারা দেশে ১ হাজার ৪২৭টি কারখানা চালু হয়েছে।

জানা গেছে, সীমিত পরিসরে রোববার থেকে গার্মেন্ট খোলার বিষয়টি অবহিত করে ২৫ এপ্রিল বিজিএমইএ শ্রম সচিবকে একটি চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু করেছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনের সদস্যভুক্ত কারখানাগুলো পর্যায়ক্রমে খোলা হচ্ছে। শুরুতে রোববার ও সোমবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কিছু কারখানা; ২৮ থেকে ৩০ এপ্রিল আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই ও মানিকগঞ্জের কারখানা; ৩০ এপ্রিল রূপগঞ্জ, নরসিংদী, কাঁচপুর এলাকা; ২ ও ৩ মে গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকার কারখানা চালু করা হবে।

কারখানা খোলার ক্ষেত্রে শুরুতে উৎপাদন ক্ষমতার ৩০ শতাংশ চালু করা হবে। পর্যায়ক্রমে তা বাড়ানো হবে।

শনিবার সদস্যদের দেয়া বিজিএমইএর গাইডলাইনে বলা হয়েছে, প্রথম ধাপে নিকটবর্তী শ্রমিকদের কাজে নিযুক্ত করতে হবে। যেসব শ্রমিক গ্রামে গিয়েছে তাদের ঢাকায় আসতে নিরুৎসাহিত করতে এবং কারখানায় প্রবেশ থেকে বিরত রাখতে হবে।

প্রাথমিকভাবে ফিনিশিং, স্যাম্পল এবং সুইং সেকশন আংশিকভাবে খোলা রাখা যাবে। সম্ভব হলে কাজের শিফট করে দেয়া এবং অপ্রয়োজনীয় দর্শনার্থীদের কারখানায় প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে হবে। লোডিং-আনলোডিং শ্রমিকদের অন্য কর্মীদের থেকে আলাদা রাখতে হবে।

কারখানায় শ্রমিকদের প্রবেশে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক এবং ভবনের বাইরে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারখানায় প্রবেশের পূর্বে থার্মোমিটার গান দিয়ে শ্রমিকদের দেশের তাপমাত্রা মাপতে হবে।

কোনো শ্রমিকের তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সে. বেশি হলে তাকে বাড়িতে বিশ্রামে পাঠাতে হবে। কারখানায় গাড়ি প্রবেশের পর জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

অবশ্য শ্রমিক নেতারা বলছেন, বিজিএমএই শুধু গাইডলাইন দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। প্রতিটি শ্রমিকের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ এ দুর্যোগের মধ্যেও বিজিএমইএ শ্রমিকদের জীবনের আগে নিজের ব্যবসার কথা চিন্তা করেছে।

তাই যেসব কারখানা খোলা হয়েছে সেগুলোতে যাতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সুরক্ষাবিধি মানা হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। যারা মানবে না, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

এ বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের (ডিআইএফই) মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় যুগান্তরকে বলেন, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আগে অধিদফতর থেকে কিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী বিজিএমইএ গাইডলাইন করে কারখানা চালু করেছে।

কারখানা খোলার ক্ষেত্রে গাইডলাইন অনুসরণ করা না হলে আরসিসির (রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল) বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বিজিএমইএকে বলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক মান পর্যালোচনা করে ১ সপ্তাহের মধ্যে অধিদফতর থেকে কারখানা চালুর বিষয়ে একটি গাইডলাইন দেয়া হবে। গার্মেন্ট মালিকদের তা অবশ্যই অনুসরণ করে কারখানা খুলতে হবে।

বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিকেএমইএ এলাকা ভাগ করে কারখানার খোলার নির্দেশনা দেয়নি। রোববার গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে কারখানা খোলা হয়েছে। এগুলোতে নিটিং, ডাইং ও স্যাম্পলের কাজ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যাদের অর্ডার আছে তাদের শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খুলতে বলা হয়েছে।

এদিকে সারা দেশে বিজিএমইএ ভুক্ত কত কারখানা খোলা ছিল, সে তথ্য দেয়নি বিজিএমইএ। এ বিষয়ে জানতে রোববার বিজিএমইএর একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি।

অবশ্য শিল্প পুলিশ বলছে, বিজিএমইএর নির্দেশ না মেনেই সারা দেশে কারখানা খুলেছেন মালিকরা। এক হাজার ৮৮২টি কারখানার মধ্যে প্রথম দিনে ৪৮০টি খোলা হয়। বিকেএমইএর ১ হাজার ১০১টি কারখানার মধ্যে ১২টি খোলা হয়। আর সব মিলিয়ে দেশে ৭ হাজার ৬০২টি কারখানার মধ্যে ১ হাজার ৪২৭টি কারখানা খুলেছে।

অথচ যুগান্তরের প্রতিনিধিদের পাঠাতে তথ্য মতে- গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জে কারখানা খোলা হয়। এসব কারখানায় শ্রমিকদের ধাক্কাধাক্কি, হুড়োহুড়ি করে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই প্রবেশ করতে দেখা গেছে।

নারায়ণগঞ্জে অর্ধশত কারখানা খুলেছে : নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি জানান, ফতুল্লার বিসিক নিট পল্লীতে গিয়ে দেখা গেছে, প্রায় আড়াইশ’ ফ্যাক্টরির মধ্যে খোলা ছিল হাতেগোনা ২০ থেকে ২২টি কারখানা। শ্রমিক উপস্থিতির সংখ্যাও ছিল অত্যন্ত কম।

তবে যে স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বলা হচ্ছিল সেই সুরক্ষার চিহ্ন খুব কমই দেখা গেছে। ৫-৬টি ফ্যাক্টরিতে জীবাণুনাশক স্প্রের পাশাপাশি ছিল থার্মাল মেশিনে শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা।

আর বাকিগুলোতে শুধু শ্রমিকদের হাতে কয়েক ফোটা স্যানিটাইজার আর পায়ে সামান্য স্প্রে করেই প্রবেশ করানো হচ্ছে। তবে শ্রমিকদের হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিপিই দেয়ার কথা থাকলেও কোন ফ্যাক্টরিতেই ন্যূনতম হ্যান্ড গ্লাভসও সরবরাহ করা হয়নি।

তবে কাজ বন্ধ রাখা এমন প্রায় অর্ধশত গার্মেন্ট ফ্যাক্টরির সামনেই ছিল বেতনের দাবিতে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ভিড়।

তারা জানান, সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর কিছু কিছু ফ্যাক্টরিতে বেতন দেয়া হলেও অধিকাংশ কারখানেই ২ মাসের বেতন দেয়া হয়নি। শুধু ফতুল্লা বিসিকই নয় ফতুল্লার পুলিশ লাইন্স এলাকার ৮টি পোশাক কারখানার শ্রমিকরাও বকেয়া বেতনের দাবিতে রোববার বিক্ষোভ করেছেন।

এ সময় একটি কারখানার শতাধিক শ্রমিক ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক প্রায় ২ ঘণ্টা অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন।

গাজীপুরে খুলেছে ৪৩৮ কারখানা : গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, জেলায় ২ মে থেকে কারখানা খোলার কথা থাকলেও নির্দেশনা উপেক্ষা করে ও চলমান লকডাউন ভঙ্গ করে করোনার ঝুঁকির মধ্যেই রোববার সকালে খুলে দিয়েছে ৪৩৮টি কারখানা।

অপরদিকে লেঅফ করা কয়েকটি কারখানা খোলা ও মার্চের বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের এসপি সিদ্দিকুর রহমান জানান, গাজীপুরে কারখানা রয়েছে ২ হাজার ৭২টি। রোববার এসব কারখানার মধ্যে ৪৩৮টি খুলেছে।

তিনি আরও জানান, ১৫-২০টি কারখানয় বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে সমস্যা চলছে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম জানান, করোনা সংক্রমণ রোধে কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কিনা তার জন্য মোবাইল কোর্ট চলছে। কিছুদিন পূর্বেও লকডাউন ও সরকারি আদেশ পালন না করে কারখানা চালানোর জন্য কয়েকটি কারখানাকে জরিমানা করা হয়েছে।

সাভার-আশুলিয়ায় একাধিক শিফট : সাভার প্রতনিধি জানান, করোনার ঝুঁকির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম মেনে অনেক কারখানা খোলা হয়। নিরাপদ দূরত্ব তৈরির জন্য নেয়া হয়েছে একাধিক শিফটের ব্যবস্থা।

আবার নিয়ম না মেনে শুধু মাস্ক ব্যবহার ও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করেই শ্রমিকদের কাজে যোগ দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে অনেক কারখানার বিরুদ্ধে। রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই এলাকার বিভিন্ন কারখানা ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

ঢাকা-১ শিল্প পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার জানে আলম বলেন, অনেক কারখানার নিরপাত্তার জন্য দুই শিফটের ব্যবস্থাও নিয়েছে, যাতে করে শ্রমিকরা দূরত্ব বজায় রাখতে পারেন। তবে পর্যাপ্ত সুরক্ষার বিষয়টি না থাকলে তাদের অবহিত করলে পুলিশের পক্ষ থেকে বিষয়টি সমাধানের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।

আদমজী ইপিজেডে ১৬টি কারখানার চালু : সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, আদমজী ইপিজেডে ৫৭টির মধ্যে রোববার খোলা হয়েছে ১৬টি। যার মধ্যে দুটি কারখানার শিপমেন্ট থাকায় এ কারখানা দুটি খোলা হয়েছে।

আদমজী ইপিজেডের ব্যবস্থাপক (জিএম) আহসান কবীর জানায়, আদমজী ইপিজেডের আশপাশের এলাকার শ্রমিকরাই মূলত কাজে যোগদান করেছেন। এর মধ্যে কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকদের কাজে যোগদান করিয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।

ডেমরায় এলাকাবাসীর বাধায় গার্মেন্ট বন্ধ : ডেমরা প্রতিনিধি জানান, সারুলিয়া এলাকায় শিফা গার্মেন্ট নামের একটি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন এলাকাবাসী। অভিযোগ রয়েছে, গত কয়েকদিন ধরে শিফা গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের এলাকার অন্তত ৮০ জন গার্মেন্ট শ্রমিক নিয়োগ দিয়েছেন।

ডেমরা থানার ওসি সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, শিফা গার্মেন্ট কর্তৃপক্ষের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারা কোনোভাবেই লকডাউনভুক্ত নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্ট শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতে পারবেন না।

এতে সহজেই এলাকায় করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া লকডাউনের এ জরুরি মুহূর্তে গার্মেন্টটি চালানোর অনুমোদনপত্র তারা দেখাতে পারেনি। এক্ষেত্রে পরে অনুমোদনপত্র দেখাতে পারলেও নারায়ণগঞ্জের কোনো গার্মেন্ট শ্রমিক এখানে কাজ করতে পারবেন না।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/301952/