২৭ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ৪:১৫

সন্তানের কান্নায় আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না

করোনার চেয়ে ক্ষুধা যাদের কাছে ভয়ঙ্কর- ৪

নাসিমার বুকে জমাট বাধা কষ্ট। প্রতিনিয়ত দীর্ঘশ^াস। ক্ষুধার্ত শিশু সন্তানের কান্নায় তার মনে কেবলই বিষাক্ত আহাজারি। কারণ নাড়িছেঁড়া ধনের কান্না থামানোর সামর্থ্য তার নেই। তাই বুকের ভেতর কষ্টের পাথরের বোঝা বহনের ক্ষমতা দিন দিন হারিয়ে ফেলছেন নাসিমা। বললেন, ‘স্যার ক্ষুধায় জ্বালায় বাচ্চাটা যখন কান্না করে তখন কোনো খাবার দিতে পারি না। বাচ্চার কান্নাও থামে না। সন্তানের এমন ক্ষুধার কষ্ট দেখে আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু সন্তানটারে দেখবে কে এই ভেবে মরতেও পারি না। উপায় না পেয়ে বাচ্চাটাকেও মারি।’

নাসিমার ভাষায়, তিনি থাকেন রাজধানীর ধলপুরে বড় বটগাছের পাশে জাহাঙ্গীরের বাড়িতে। এক সন্তান। বয়স প্রায় ৫ বছর। টিকাটুলিতে প্রধান রাস্তায় খাবারের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। জানালেন, স্বামী থাকলেও কোনো আয় নেই। আগে মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চলত। এখন বাসার কাজও বন্ধ। ঘরে খাবার বলতে কিছু নেই। সামান্য জমানো টাকা ছিল। তা দিয়ে কয়েক দিন চলতে পেরেছে। এখন তাও শেষ। নিরুপায় হয়ে এবার সন্তানসহ রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু তাতেও অনিশ্চয়তা। কারণ ফাঁকা রাজধানী। যারা বিশেষ প্রয়োজনে বের হয় তাদের সংখ্যা খুবই কম। এদের কাউকে দেখলে নাসিমার মতো অসংখ্য নারী হাত পাতে। কেউ পায় তো, কেউ পায় না। এভাবে করে সারা দিনে যদি কিছু জোটে তবে হয় তো একবেলা পেট চলে নয়তো পানিই ভরসা।

নাসিমা বলে যান তার স্বপ্নের কথা, তার ছোট শিশু। প্রতিদিন এটা ওটা চায়। কিন্তু খাবারই যেখানে জোটে না সেখানে অন্য কিছুতো স্বপ্ন। দিনে রাতে যখনই ক্ষুধা পায় কান্না করে অবুঝ এ শিশু। এ সময় বুকের দুধ দিয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা ভোলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে লাভ হয় না। এরপর এদিকে ওদিক হাটেন কিন্তু তাতেও থামাতে না পেরে মারেন। বললেন, নিজের সন্তানকে কোন মায় মারতে চায় বলুন। কিন্তু আমি মা। সন্তানের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। তাই নিরুপায় হয়ে নিষ্ঠুর হই। এরপর নিজের ওপর নিজের অভিমান হয় মনে, আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। কিন্তু পারি না। কারণ আমার সন্তানকে কে দেখবে।

নাসিমা জানান, এলাকার কিছু লোক সাহায্য দেয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে পরিচয় পত্র নিয়ে গেছে। নাম ফোন নাম্বারসহ সবই লিখেছে। কিন্তু এরপর থেকে তাদের আর কোন খোঁজ নেই। অনেক অপেক্ষার পর নিজেই তাদের খোঁজতে বের হয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। আশপাশের কয়েকজন জানিয়েছেন, এদের পেছনে ঘুরে লাভ হবে না। এরা নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কাউকে সহযোগিতা করবে না। এমনটা শোনার পর তিনি সে আশাও ছেড়ে দিয়েছেন। তাই নিরুপায় হয়ে রাস্তায় নেমে আসা। কিন্তু অভাবী মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, রাস্তায় স্বপ্ল সংখ্যক চলাচলকারী যারা দান করতে চান, তারা কাকে রেখে কাকে দেবেন। ওরাও এমন পরিস্থিতিতে হিমশিম খান। তাই এখন ভাগ্যের ওপরই সব ছেড়ে দিয়েছেন। বললেন, হায়াত থাকে তো বাঁচব, নয়তো মারা যাবো’। কিন্তু সন্তানের কি হবে সে চিন্তায় ঘুমাতে পারি না’। এ সময় নাসিমার আশপাশে থাকা কয়েজন জানান তাদেরও একই অবস্থা। সব চেষ্টার পর তাদেরও শেষ ঠিকানা এখন রাস্তা।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/498279