২২ এপ্রিল ২০২০, বুধবার, ৫:৫৬

করোনার সংক্রমণ বাড়ছে

মাঠের যোদ্ধাদের সুরক্ষা জরুরি

১৬১ চিকিৎসকসহ ৩৯৬ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত * ১৩৩ পুলিশ কর্মকর্তা আক্রান্ত, ঝুঁকিতে ৬৩৩ * প্রশাসনের ৮ কর্মকর্তা আক্রান্ত * মাঠের চার যোদ্ধার মৃত্যু

মাঠের প্রথম সারির যোদ্ধারাই এবার করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীরা একে একে ভাইরাসটির সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সংক্রমণের কারণে কয়েকটি হাসপাতালের কাজ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়া প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে মাঠে যুদ্ধ করতে গিয়ে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। এরই মধ্যে এক চিকিৎসকসহ চারজন মারা গেছেন। এভাবে চলতে থাকলে সারা দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, মাঠের এই যোদ্ধাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এখন থেকে পালাক্রমে দায়িত্ব দেয়া হবে। একটি গ্রুপ একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ করবে। এরপর যাবে অন্য গ্রুপ। এতে কোনো একটি পালার লোকজন আক্রান্ত হলে তাদের কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে অন্য দল কাজ করবে। জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৬১ চিকিৎসক, ৬৬ নার্স এবং ১৬৯ স্বাস্থ্যকর্মীসহ ৩৯৬ জন আক্রান্ত। পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে ১৩৩ জন, সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে ৬৩৩ জন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ ১৮ জন গণমাধ্যমকর্মীর করোনাভাইরাস পজিটিভ। খাদ্য ও ত্রাণ কর্মকর্তা আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় এক ডজন। এ ছাড়া প্রশাসনের কমপক্ষে ৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আক্রান্ত হয়েছেন এই মহামারীতে। ইতোমধ্যে এক চিকিৎসকসহ প্রশাসনের খাদ্য ও ত্রাণ বিভাগের মোট চারজন মারা গেছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা বিভাগের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। তিনি বলেন, ১১৮ জন চিকিৎসক শুধু ঢাকা বিভাগেই, আর ঢাকা সিটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ জন। তবে ঢাকা বিভাগের মধ্যে ঢাকার বাইরে কিশোরগঞ্জ জেলায় বেশি। তিনি বলেন, চিকিৎসকরা যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, এ পরিস্থিতি খুবই ভীতিকর এবং উদ্বেগজনক। এভাবে যদি চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হতে থাকেন, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ে সব মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, শুরুতে বিলম্ব হয়েছে। আর দেরি না করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে না হলেও কমপক্ষে পাঁচ হাজার চিকিৎসক, পাঁচ হাজার নার্স এবং অন্তত এক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্টকে নিয়ে বিশেষ পুল তৈরি করতে হবে। আগামীকাল থেকেই এ কার্যক্রম চালু করা উচিত।

জানা গেছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশেও বাড়ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। বাড়ছে মৃত্যুর হার। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে নতুন করে আরও ৪৩৪ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে আরও ৯ জনের। এ নিয়ে দেশে সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৩ হাজার ৩৮২ জনে। মোট মৃত্যু ১১০। মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা ৮৭ জন। নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৯ হাজার ৫৭৮টি।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর সভাপতি ডা. ইকবাল আর্সলান যুগান্তরকে বলেন, ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের যেসব সুরক্ষাসামগ্রী দেয়া হয়েছে, তা কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। এ কারণে অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন। তাছাড়া রোগীরাও তথ্য গোপন করায় ডাক্তারদের আক্রান্তের হার বেড়েছে। ডাক্তার স্বাস্থ্যসেবা কর্মীসহ যারা করোনা প্রতিরোধে মাঠে কাজ করছেন তাদের সুরক্ষা অবশ্যই দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। নইলে করোনা প্রতিরোধে লোকবল পাওয়া যাবে না।

করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলার কাজে যুক্ত পুলিশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এ পর্যন্ত আমাদের ১৩৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৭৩ জন, বাকিরা রাজধানীর বাইরের। এ ছাড়া করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন পুলিশের ৬৩৩ জন সদস্য। তাদের মধ্যে ১৪৩ জন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে এবং বাকিরা হোম কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। পুলিশ সদস্যরা ত্রাণ বিতরণ, রোগীদের হাসপাতালে আনানেয়া, লকডাউন নিশ্চিতকরণসহ করোনা রোগীদের দাফন-কাফনের কাজও করছেন। ফলে তাদের সুরক্ষাই প্রথমে ভাবতে হবে আমাদের। তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও জানান সোহেল রানা।

করোনা প্রতিরোধে সারা দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে জনপ্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) আর উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) করোনা প্রতিরোধ, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাসহ সব ধরনের কাজ করছেন। ইতোমধ্যে মাঠপর্যায়ের ৮-১০ জন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন সচিব শেখ ইউসুফ হারুন যুগান্তরকে বলেন, মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা খরচসহ সব ধরনের দায়-দায়িত্ব সরকার বহন করবে। এ ছাড়া সরকার ঘোষিত প্রয়োজনে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হবে। যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে যারা মাঠে তাদের সংস্পর্শে ছিলেন তাদেরকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। মাঠ প্রশাসনসহ দেশের সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রেখে কাজ করার জন্য আগে থেকেই নির্দেশ দেয়া আছে। একজন অফিসারের ওপর অনেক কাজের দায়িত্ব। তাই তারা বেশি আক্রান্ত হয়ে গেলে পুরো দেশের কাজের সমস্যা হবে। নারায়ণগঞ্জে ইতোমধ্যে দু’জন নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আশা করি, কাজের কোনো সমস্যা হবে না।

খাদ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে অধিদফতরের সুরুজ মিয়া নামে এক কর্মচারী মারা গেছেন। অনেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মনিরুজ্জামান জানান, করোনা প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশে ডাক্তার, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সারা দেশের খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঝুঁকির মধ্যে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। গুদামগুলো থেকে ত্রাণ, ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী সারা দেশে সরবরাহ করছেন খাদ্য কর্মকর্তারা। অথচ তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কোনো সামগ্রী দেয়া হয়নি।

খাদ্য বিভাগের মতো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জের একজন রেডিও অপারেটর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর বাইরেও অনেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি।

যুগান্তরের ব্যুরো ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন-

নরসিংদী : জেলা হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন অফিসের ৫ চিকিৎসকসহ বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৪৪ স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। নরসিংদী জেলা করোনা প্রতিরোধ ইমারজেন্সি সেল প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইমরুল কায়েস এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ময়মনসিংহ : গফরগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৯ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর পর এবার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫ চিকিৎসকসহ ১৪ জন নার্স, আয়া ও ক্লিনার করোনায় আক্রান্ত। সিভিল সার্জন ডা. এবিএম মসিউল আলম এ তথ্য জানান।

কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জে আক্রান্তদের মধ্যে ৯৩ জনই স্বাস্থ্য বিভাগের লোক। এদের মধ্যে ৪১ জন ডাক্তার, ১০ জন নার্স ও ৪২ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। কিশোরগঞ্জের করোনা প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব সিভিল সার্জন ডা. মুজিবুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

হবিগঞ্জ : লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন ডাক্তার ও এক নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান।

রাজশাহী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের ১৯ চিকিৎসকসহ ৪০ জনকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ১৫ জন ইন্টার্ন। এ ছাড়া ১০ জন নার্স এবং বাকি ১১ জন আয়া ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী।

ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ) : ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের স্বাস্থ্যসহকারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বিধান চন্দ্র দেবনাথ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/300408/