২০ এপ্রিল ২০২০, সোমবার, ৬:০৮

বাড়ছে অভাবীদের ক্ষুধার যন্ত্রণা

প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বিক্ষোভ; দীর্ঘ হচ্ছে ত্রাণের লাইন, সমবণ্টন দাবি

অভাবী মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা বাড়ছে। ত্রাণ চাই, এমন দাবি নিয়ে মাঠে নামতে শুরু করেছে কর্মহীন অসহায় মানুষ। এরা বলছে ‘করোনার ভয় আছে, কিন্তু তার চাইতে বড় হলো ক্ষুধার যন্ত্রণা’। ত্রাণ আছে, ত্রাণ নাই, কেউ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে নাÑ এমন অবস্থা এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। উপরন্তু একের পর এক খাদ্যসামগ্রী চুরির ঘটনা গরিব মানুষদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। লকডাউন ভেঙেই তারা বিক্ষোভ করছে।

মহামারী করোনা রুখতে লকডাউনের অপরিহার্যতা আরো বাড়লে, কর্মহীনদের খাবারের অভাব আরো প্রকট হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের দেয়া ত্রাণের সুষম বণ্টনের ওপর জোর দিয়েছেন তারা। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক জরিপের তথ্যে উঠে এসেছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের ৭০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এতে দেখা যায়, শহরে বস্তিতে বসবাসরত ৮২ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আর গ্রামাঞ্চলে কর্মহীন হয়েছে ৭৯ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। ওই জরিপ বলছে, করোনার প্রভাবে দেশে ৭০ শতাংশ গরিব মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এই শ্রেণীর মধ্যে যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে ছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে তারাও দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে। ৪০ শতাংশ দরিদ্র শ্রেণীর ভোগ কমে গেছে। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে শহরের ৭১ শতাংশ দরিদ্র মানুষের। এ বিষয়ে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে কর্মহীন ও আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষদের নগদ টাকা দেয়া জরুরি। সে ক্ষেত্রে প্রতি মাসে গরিব মানুষদের জন্য খরচ হবে পাঁচ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। দেশে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা তিন কোটি ৮১ লাখ ৫৬ হাজার ৬৬৯ জন। যার মধ্যে গ্রামে তাদের সংখ্যা দুই কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩০ জন আর শহরে দরিদ্র এক কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার ১৩৯ জন।

শহরে কর্মহীন মানুষের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জেও খাবারের অভাব বাড়ছে। কোথাও কোথাও বিক্ষোভ করছে ঘরে বসে থাকা বুভুক্ষুরা। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারণে বসে থাকলেও খাবার সংগ্রহে বের হতে বাধ্য হচ্ছে তারা। সরকার থেকে এপ্রিলের শুরুতে ত্রাণের জন্য তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেয়া হলেও অনেক জায়গায় এখনো তালিকা সম্পূর্ণ হয়নি। ফলে করোনা সংক্রমণ রোধে ঘরে থাকা অপরিহার্য হলেও অভাবীদের ঘরে রাখা কঠিন হতে শুরু করেছে।

সাম্প্রতিক কিছু চিত্র : গত ১২ এপ্রিল ত্রাণের দাবিতে লকডাউন ভেঙে রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করেছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের তিনটি গ্রামের শতাধিক নি¤œ আয়ের পরিবারের শত শত নারী-পুরুষ। এ সময় কামালপুরের বাসিন্দা রহিমা বেগম ক্ষোভ নিয়ে জানান, তিন দিন যাবৎ তারা ত্রাণের জন্য যাচ্ছেন, কিন্তু প্রতিবারই তারা খালি হাতে ফিরে এসেছেন। বৌবাজারের ফরিদা বেগম বলেন, আমরা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়ে ত্রাণ পাই না, তারা মুখ চিনে চিনে লোক মারফত অনেকের বাসায় খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছে। একই দিন নাসিক ২২ নং ওয়ার্ড বন্দর বাজার মসজিদ সংলগ্ন কাউন্সিলর সুলতান আহম্মেদের কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করেন শতাধিক নারী-পুরুষ। এ সময় স্থানীয় কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করে বিভিন্ন সেøাগান দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।

লালমনিরহাটে সাধারণ ছুটিতে কাজ হারানো শ্রমজীবী মানুষ ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ইউনিয়নের হাঁড়িভাঙ্গা এলাকায় শতাধিক কর্মহীন মানুষ লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কে অবস্থান নেয়। কাজ হারিয়ে নিরন্ন অবস্থায় থাকলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো সাহায্য তাদের কাছে পৌঁছায়নি।

বেশ কিছু দিন যাবত ঘরে খাবার না থাকায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে মাদারীপুরের মস্তফাপুর ইউনিয়নের গরিব কর্মহীন মানুষ। কাজ নেই, খাবার নেই, সরকারি ত্রাণ দেয়ার কথা থাকলেও এখনো কারো ঘরে কিছুই পৌঁছায়নি, এমন অভিযোগ করে তারা ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে।

রাজধানীতেও ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে কর্মহীনরা। গত ১৪ এপ্রিল সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় শত শত মানুষ বিক্ষোভ করে। পরে ১১টার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলেও কাজ হয়নি। এ সময় রাস্তায় রিকশা উল্টে রেখে বিক্ষোভ দেখান তারা। তাদের দাবি, সরকার ১০ টাকা কেজি করে চাল বিক্রি করছে। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে চাল-ডাল বিতরণ করলেও এখন পর্যন্ত এই এলাকার কোনো মানুষ সরকারি এই সুবিধা পায়নি। ফলে না খেয়ে দিন পার করছেন এখানকার মানুষগুলো। বিক্ষোভকারীরা বলেন, কাউন্সিলরদের কাছে অনেক ত্রাণ গেলেও তারা এর কিছুই পাচ্ছেন না। মুখ দেখে ত্রাণ দেয়া হচ্ছে বলে তারা দাবি করছেন।

যশোর সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুরে ত্রাণের চাল না পেয়ে বিক্ষোভ করেছেন গ্রামবাসী। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সেনা সদস্যরা সেখানে গিয়ে নতুন করে তালিকা তৈরি করে ত্রাণ দেয়ার আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা শান্ত হন।

খুলনার রূপসায় ত্রাণের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন এলাকাবাসী। পেটের ক্ষুধায় তারা রাস্তায় নেমেছেন বলে ভুভোগীরা জানান। গত ১৪ এপ্রিল সকালে এসব মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। উপজেলার পূর্ব রূপসা বাজার পার্শ্ববর্তী আদর্শগলির শত শত নারী-পুরুষ এ বিক্ষোভে অংশ নেন। তাদের বড় অংশই স্থানীয় মাছ প্রক্রিয়াজাত কারখানায় কর্মরত। পরে তারা খুলনা-মোংলা মহাসড়কে সেনাবাহিনীর টহল গাড়ি পেয়ে তাদের কাছে দাবি তুলে ধরেন। তারা দাবি করেন, এলাকার প্রতিটি মানুষ ঘরে থাকলেও তাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ বা খাদ্য আসেনি।

গ্রামের তুলনায় শহরের নি¤œ ও মধ্যম আয়ের মানুষের সাংসারিক খরচ কয়েক গুণ বেশি। কেননা সবাইকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাড়ি ভাড়া দিতে হয়, সাথে পানির বিল, বিদ্যুৎ বিল শোধ করতে হয়। ওএমএসের ১০ টাকা কেজির চাল কেনার জন্য সাধারণ মানুষের দীর্ঘলাইন বলে দিচ্ছে খাদ্যের লড়াইটা শহরেও তীব্র হচ্ছে।

এ দিকে টিআইবি ত্রাণ কার্যক্রমে সহায়তা দিতে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ‘ত্রাণ কমিটি’ গঠনের ঘোষণায় সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এই উদ্যোগ যেন ‘স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তা দেয়ার’ মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। টিআইবি গত শুক্রবার বিবৃতিতে বলেছে, জাতির ক্রান্তিলগ্নে সব ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে সবার সর্বাত্মক অংশগ্রহণ জরুরি হলেও বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণসামগ্রী চুরি ও আত্মসাৎসহ বিভিন্ন দুর্নীতি এবং তাতে দলীয় নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার যে খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে এই দলীয় ‘ত্রাণ কমিটি’ কতটুকু ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে তা নিয়ে সংশয় থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/496834/