১৯ এপ্রিল ২০২০, রবিবার, ১২:০১

ত্রাণসামগ্রী চুরি ও আত্মসাৎ

জনপ্রতিনিধিরা আস্থার সঙ্কটে

কিছু কিছু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের কারণে গোটা দেশের জনপ্রতিনিধিরা এখন আস্থার সঙ্কটে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে সরকারি নম্বরে ফোন দিয়ে ত্রাণ চাওয়ায় বরমহাট ইউপির চেয়ারম্যান কর্তৃক কৃষককে মারধর করে রক্তাক্ত করা এবং কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দ চাল চুরি ও আত্মসাতের কারণে এমপি থেকে শুরু করে ইউপির মেম্বার পর্যন্ত সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের কর্মকাণ্ড এখন প্রশ্নের মুখে। দেশজুড়েও সমালোচনার ঝড় বইছে। বিশেষ করে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে ত্রাণ ও সরকারি বরাদ্দকৃত চাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণের ওপর কোনোভাবেই আস্থা রাখতে পারছে না সাধারণ মানুষ।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশের এই বর্তমান পরিস্থিতিতে দিনমজুর, খেটে খাওয়া ও নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীরা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তারা ঘর থেকেও বের হতে পারছে না। এ সময়ে অসহায় ও গরিব মানুষের জন্য ওএমএস, ভিজিএফ ও ভিজিডিসহ সরকারিভাবে যে বিশেষ বরাদ্দকৃত চাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্য দেয়ার কথা তা যদি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা লুটে নেয় তাহলে ওই মানুষগুলোতো না খেয়ে মরবে। আর চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ডিলাররা মিলে যেভাবে চুরি ও আত্মসাৎ করছে তাতে এখন আর তাদের ওপর আস্থা রাখা যায় না। বিকল্প পদ্ধতিতে বণ্টন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া যেতে পারে। তা ছাড়া বণ্টনের ক্ষেত্রে টাস্কফোর্স গঠন, এনজিওসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের সহায়তা নিলে খাদ্যসঙ্কটে পড়া মানুষগুলো বেঁচে যাবে।

করোনাভাইরাস বৈশ্বিক সমস্যা। এই দুর্যোগ মোকাবেলায় গত ২৫ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। তিন সপ্তাহ ধরে চলা সাধারণ ছুটির মধ্যে দেশের খেটে খাওয়া ও কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের মানুষ চরমভাবে খাদ্যসঙ্কটে পড়েছে। এসব মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য সরকার রুট লেভেলে ওএমএসের চাল ১০ টাকা করে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ওই চাল বিতরণে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। ইতোমধ্যে দুই শ’র বেশি জনপ্রতিনিধি ও ডিলারের বাড়ি থেকে শত শত টন চাল উদ্ধার করা হয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে দেয়া ভোজ্যতেলও মজুদ ও আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতির সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকায় অনেকেই গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করছেন। কাউকে কাউকে জরিমানা করা হয়েছে। দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় ইতোমধ্যে পাঁচজন ইউপি চেয়ারম্যান ও সাতজন মেম্বারকে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

তথ্য মতে, গত ১০ বছরে টিআর, কাবিখা কর্মসূচি বাস্তবায়নে কয়েকজন এমপির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। আর এখন দেশের এই ক্রান্তিকালে যখন মানুষ অনাহারে ভুগছে তখন ওই সব মানুষের পাশে নেই অধিকাংশ এমপি। জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, এই মহাদুর্যোগের মধ্যে যদি জনপ্রতিনিধিরা জনগণের পাশে না থেকে আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে তাহলে তারা কবে পাশে থাকবে সাধারণ মানুষের? দুর্নীতির কারণে ১০ টাকা কেজি দরে ওএমসের চাল বিক্রি ইতোমধ্যে স্থগিত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারি নম্বরে ফোন দিয়ে ত্রাণ সহায়তা চাওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এক কৃষককে মেরে রক্তাক্ত করেছে, যা খুবই দুঃখজনক। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ এখন ঘরবন্দী। কর্মহীন হয়ে পড়েছে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষজন। তাদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল হরিলুট করছে চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। আসলে ভোটচুরি করে নির্বাচনে জিতলে দেশের মানুষের প্রতি কি দায়িত্ব থাকে? কারো কোনো জবাবদিহিতাও নেই। পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে বাদ দিয়ে দলীয় লোকজনের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। এটাও একটা নোংরামি। আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষকে নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা জরুরি। ত্রাণ বিতরণের জন্য এনজিও, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ এ রকম অনেক সংগঠন আছে, যারা দেশের মানুষের জন্য কাজ করে। তাদেরকে সংযুক্ত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব মো: গোলাম মোস্তফা ভুইয়া নয়া দিগন্তকে বলেন, সামগ্রিকভাবে দেশের সব পর্যায়ে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা গরিবের হক মেরে খাচ্ছে, এটা নতুন কিছু নয়। যদিও এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের আগেই চেয়ারম্যান প্রার্থীরা মনে করেন, নৌকা পেলেই তো জিতে যাবো। এই যে ধারণা, এ থেকেও তাদের ভেতরে ভেতরে একটা অস্বচ্ছ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। আর এখন তো কোনো জবাবদিহিতা নেই। যদি চাল চুরি করার পর কয়েকজনকে কঠিন শাস্তি দিত তাহলে অন্যরা উৎসাহিত হতো না। এভাবে মানুষেরও তাদের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/496612