৭ এপ্রিল ২০২০, মঙ্গলবার, ৫:১১

বস্ত্রখাতে সঙ্কটের মূলে পশ্চাদশিল্পে অবহেলা

চোরাই কাপড়ে দেশী বাজার সয়লাব; সক্ষমতা হারাচ্ছেন দেশী উদ্যোক্তারা; আমদানিতেই বেশি আগ্রহী সরকার

করোনাভাইরাসের কারণে গভীর সঙ্কটে পড়েছে দেশীয় বস্ত্রখাত। সরকারের অবহেলা আর সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তাদের অতিরিক্ত লোভের কারণে ধ্বংস হতে বসেছে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে তিলি তিলে গড়ে ওঠা এ উপখাতটি। এর মূলে রয়েছে পশ্চাদশিল্পের প্রতি অবহেলা। দেশে উৎপাদিত সুতা ও বস্ত্র ব্যবহারে গার্মেন্ট মালিকদের বরাবরই অবহেলা। তারা আগ্রহী আমদানিপণ্যে। কারণ এর মাধ্যমে ইচ্ছেমতো ইনভয়েস করা যায়, বড় লোক হওয়া যায় রাতারাতি। স্বাভাবিক কারণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে বসে থাকা কর্মকর্তারাও আমদানিবাণিজ্যকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছেন। এখন করোনার কারণে সারা বিশ্বে যখন অচলাবস্থা তখনই টের পাওয়া যাচ্ছে দেশীয় এ শিল্পের প্রয়োজনীয়তা। সংশ্লিষ্টরা এখন অকপটে স্বীকার করছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে গার্মেন্টসহ সামগ্রিক বস্ত্র খাতে বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সেটি তাদেরই ব্যর্থতার ফসল।

সংশ্লিষ্ট খাতের একাধিক উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, সম্ভাবনাময় দেশীয় টেক্সটাইল এবং স্পিনিং খাত এখন ধ্বংসের মুখে। গত কয়েক বছরে বহু টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। এখন একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সুতা কলগুলো। যেগুলো চালু আছে, তাদের উৎপাদিত সুতা বিক্রি হচ্ছে না। গোডাউনে সুতার পাহাড় জমছে কিন্তু সুতা তৈরির জন্য তুলা নেই। স্পিনিং মিলগুলোতে বর্তমানে আড়াই লাখ টন সুতা অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক চক্র অত্যন্ত কৌশলে বাংলাদেশে পুরো বস্ত্র খাতকে করায়ত্তে নিয়ে নেয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বলে শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে। তারা যেভাবে সুতা, বস্ত্র ও গার্মেন্ট খাতকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে, তাতে আগামীতে ভিনদেশীদের একচেটিয়া ব্যবসার হাতে বাংলাদেশকে পুতুল হয়েই থাকেতে হবে। বিদেশী আগ্রাসনের ফলে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের স্পিনিং, টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাত ধ্বংস হয়ে পরনির্ভর হয়ে পড়বে। এদিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মিল মালিকরা এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে ব্যস্ত।

উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, সময় থাকতে যদি কাপড়ের মিলগুলোকে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হতো, তাহলে আজ চীনের কাপড়ের জন্য গার্মেন্টগুলোকে বসে থাকতে হতো না। ৩০ বছর ধরে সব সরকার একশ্রেণীর নেতিবাচক আমলাদের ফাঁদে পা দিয়ে সঠিক নীতি প্রণয়ন করতে পারেনি। বাস্তব অবস্থা না বুঝে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নীতিনির্ধারক মহল ভুলপথে হেঁটেছেন। ফলে সেভাবে কোমর সোজা করে দাঁড়াতেই পারেনি খুবই সম্ভাবনাময় এই সেক্টর। তারা বলেন, প্রণোদনা বহাল রাখাসহ বেশি সুবিধা দেয়ার কথা ছিল সুতা ও কাপড়ের মিলে। কিন্তু সরকার দিয়েছে শুধু গার্মেন্টে, যারা শুধু সেলাইয়ের কাজ করে। তাদের নামে বেশি বেশি রফতানি আয় দেখিয়ে বাহবা দেয়া হচ্ছে। আয় বেশি দেখাতে মোট রফতানি আয় থেকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির হিসাব বাদ দেয়া হয় না। বিপরীতে নব্বইয়ের দশকে স্পিনিং খাতে দেয়া ২৫ শতাংশ প্রণোদনা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা হয়েছে।

জানা যায়, ১৯৯০ সালের দিকে যখন দেশে সুতার মিলের যাত্রা শুরু হয়, তখন সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ শতাংশ প্রণোদনা সুবিধা দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে সেটি কমাতে কামতে একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এভাবে প্রণোদনা দেয়ার কারণে সেসময় অনেক মিল গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আসল কাজ না করে উল্টো প্রণোদনা বন্ধ করে দেয়া হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুতার মিলে এখন সবচেয়ে বেশি দরকার হলো আমদানিতে শতভাগ প্রটেকশন দেয়া। অবৈধভাবে সুতা আসা ঠেকানোর পাশাপাশি বৈধ পন্থায় সুতার আমদানিও সীমিত করতে হবে। তাহলে সঙ্গতকারণে দেশীয় সুতার চাহিদা ও বিক্রি বাড়বে। এভাবে এসব মিল শক্ত অবস্থানে চলে আসবে। কিন্তু এখানে সুতা আমদানি উন্মুক্ত করা ছাড়াও প্রতিদিন চোরাই পথে দেদার সুতার চালান ঢুকছে। এ ছাড়া বন্ডের সুতায় বাজার তো সয়লাব।

জানা যায়, ভারতসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের সুতা ও বস্ত্র খাতের বাজার পুরোপুরি দখলে নিতে সুকৌশলে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এক দিকে তারা এ খাতকে দিচ্ছে আকর্ষণীয় প্রণোদনা সুবিধা, ব্যাংক ঋণের সুদের হারও রেখেছে সর্বনিম্ন। ফলে ভারতীয় সুতা কলগুলোর উৎপাদন খরচ বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম পড়ছে। কেজিপ্রতি তারা ৫ ডলার থেকে ৫ ডলার ২০ সেন্ট দরে বিক্রি করছে। আর নানা বৈধ-অবৈধ পথে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে এই কম দামের সুতা ঢোকায় দেশীয় সুতার কারখানাগুলো অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। তা ছাড়া ইইউতে জিএসপির নতুন শর্তে বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে। কয়েক বছর ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধার শর্ত পরিবর্তন করেছে। এর ফলে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের স্পিনিংসহ টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা। জিএসপির শর্ত পরিবর্তন করায় এখন বিদেশ থেকে সুতা ও কাপড় আমদানি করে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। শুধু সেলাই করেই পোশাক ইউরোপে শুল্কমুক্তভাবে রফতানি করতে পারছে তারা। আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশে বিপুল পরিমাণ সুতা অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অথচ দেশের ৮০ শতাংশ কাপড়ের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করছে আমাদের দেশের তাঁত শিল্প। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তাঁতি সমাজে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছু অজ্ঞ লোক সরকারকে ভুল বোঝানোর কারণে দেশের ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠছে না। যদি দেশে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠত, তাহলে আমাদের চীনের কাছে ধরনা দিতে হতো না। দেশের টেক্সটাইল খাতই ওভেন কাপড়ের চাহিদা মেটাতে পারত। কিন্তু দেশের সুতা ও কাপড়ের মিলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, তা ৩০ বছরে কোনো সরকারই নেয়নি। একশ্রেণীর আমলা ও ব্যবসায়ী সরকারকে বোঝাতে চায়, তুলা আমদানিনির্ভর হওয়ায় দেশে টেক্সটাইল শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এটা ডাহা মিথ্যা কথা। জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান এক সময় ফেব্রিক্সে লিড দিত। ওইসব দেশে কি তুলা উৎপাদন হতো? হতো না। আবার আফ্রিকা ও উজবেকিস্তানে তুলা উৎপাদন হয়, সেখানে কি টেক্সটাইল শিল্প গড়ে উঠেছে? তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা করেছি, কিন্তু ফল পাইনি। কারণ, ওই শ্রেণীর আমলা ও একটি চক্র সব সময় তাদের স্বার্থে সরকারকে ভুল বোঝায়।

ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের উন্নয়নে শুরুতেই মনিটরিং বডি গঠন করা দরকার ছিল জানিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতিরি (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ওভেন খাতে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে ওঠেনি পর্যাপ্ত নীতিসহায়তার অভাবে। এর পেছনে ব্যবসায়ী নেতাদের ভূমিকা আছে। বস্ত্র খাতের সব সংগঠন এক হয়ে সমস্যাগুলো সরকারের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেনি। এখন কাজ হবে পর্যায়ক্রমে আমদানি কমিয়ে এনে দেশের অভ্যন্তরে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বাড়ানো। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় প্রণোদনা অব্যাহত রাখা, যা আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো করছে। নিট খাতে সহায়তা দেয়ায় এখন ৮৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওভেন খাতে বড় বিনিয়োগ দরকার। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ দিয়ে ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব না। সরকারের উচিত হবে, ওভেন খাতে বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে এই সেক্টরের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা।

ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সহসভাপতি মো: সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চীনের করোনাভাইরাসের কারণে দেশের গার্মেন্ট খাত এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এর কারণ, ওভেন খাতে পর্যাপ্ত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে না ওঠায় এখনো ৭০ শতাংশের বেশি কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে কিছু টেক্সটাইল গড়ে উঠলেও সেগুলো চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় পারছে না। কারণ, দেশে উৎপাদিত ফেব্রিক্সের দাম কিছুটা বেশি। উপরন্তু, ব্যাংক ঋণের এত উচ্চ সুদ দিয়ে প্রতিযোগী সক্ষমতা গড়ে তোলা সম্ভবও নয়। এজন্য দেশী ওভেন ফেব্রিক্স উৎপাদনে সরকারকে ভর্তুকি দেয়া উচিত। এতে সরকারের লাভ হবে। কারণ এক দিকে কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্য দিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/494147/