৪ এপ্রিল ২০২০, শনিবার, ১২:৩৯

করোনায় স্থবির স্বাস্থ্যসেবা

জ্বর-সর্দি-কাশিসহ সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না

করোনা সন্দেহে পাঁচ হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেয়ার পর, ধুঁকে ধুঁকে আল আমিন (২২) নামে যুবকের মৃত্যু হয়েছে। জ্বর-সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে গত শনিবার বিকালে আল আমিন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মৃত্যু হয়। নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার অলংকারদীঘি গ্রামের বাসিন্দা আল আমিনের বাবা মোখলেসুর রহমান জানান, তার ছেলে নারায়ণগঞ্জে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করত। শনিবার সকালে সে জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে বাড়িতে ফেরে। এ সময় গ্রামের লোকেরা তাকে গ্রামে থাকতে নিষেধ করে। তাই দ্রæত তাকে নওগাঁ জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেখানকার চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করেন। উপায়ান্তর না দেখে পার্শ্ববর্তী বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা হাসপাতালে যান। সেখানেও তাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকার করে। পরে রানীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল মামুনকে জানালে তার হস্তক্ষেপে আল আমিনকে প্রথমে রানীনগর উপজেলা হাসপাতাল ও পরে আবার নওগাঁ জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বিকালে রামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করান। রাত সাড়ে ৮টার দিকে আল আমিন মৃত্যুবরণ করে। রামেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সাইফুল ফেরদৌস জানিয়েছেন, সর্দি, জ্বর ও শ্বাসকষ্টসহ করোনার বিভিন্ন উপসর্গ থাকলেও আল আমিন মারা গেছেন মেনিনজাইটিস বা মস্তিষ্কের সংক্রমণে।

গত বুধবার ডা. তানিয়া শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় তার মাকে নিয়ে রাজধানীর ৫টি সরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হন। কিন্তু নিজে চিকিৎসক হয়েও কোথাও তার মায়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে পারেননি। বাসায় তার বাবা স্ট্রোকের কারণে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন। বন্ধ রয়েছে তার নিয়মিত চিকিৎসা।
এখানেই শেষ নয়; এ্যাম্বুলেন্সে দু’দিন ধরে ছয় ছয়টি হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করেও কোথাও ন্যূনতম চিকিৎসা না পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা মো. আলমাস উদ্দিনের করুণ মৃত্যু নাড়া দিয়েছে পুরো জাতিকেই। গত রোববার তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গত কিছুদিন থেকে এভাবে কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে অনেকের মৃত্যুর খবর সামনে এলেও পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি। শেষ পর্যন্ত যেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন করোনা মোকাবেলার নামে কিভাবে রীতিমতো ভেঙে পড়েছে সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা।

সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশি তো নয়ই, কিডনি, হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্তরাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না হাসপাতালে। চিকিৎসার আশায় ছুটছে মানুষ। সরকারি হাসপাতালে সিট খালি, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বারও বন্ধ। করোনা আতঙ্কে হাসপাতালে ডিউটিতে যাচ্ছেন না অনেক চিকিৎসক। ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতেও নেই টেকনিশিয়ান ও টেকনোলজিষ্ট। রোগীদের কান্না স্পর্শ করছে না ডাক্তারদের। সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই নেয়া হচ্ছে না ভর্তি, দেয়া হচ্ছে না চিকিৎসা। চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। রীতিমতো যেন ভেঙে পড়েছে সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। যদিও এর কারণ হিসেবে ব্যক্তিতগ সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) না পাওয়াকে দায়ী করেছেন চিকিৎসকরা। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, পিপই সঙ্কট নেই। পর্যাপ্ত মজুদ আছে। আর এমন পরিস্থিতিতে অনেক রোগী এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটাছুটি করতে করতেই প্রাণ হারাচ্ছেন। প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারাদেশে চিকিৎসা না পেয়ে রোগী মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই তালিকা প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। ইতোমধ্যে সারাদেশে অর্ধশতাধিক রোগীর চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর খবর উঠে এসেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে।

চারদিকে হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার খবরে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই। এমনকি ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্য মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের ডেকে সাধারণ রোগীদের যাতে চিকিৎসা পেতে অসুবিধা না হয় সেদিকে গুরুত্বারোপ করেছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। পাশাপাশি যারা চিকিৎসা দিবেন না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে ‘কোভিড-১৯’-এ আক্রান্ত হয়ে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসা না পেয়ে। চিকিৎসকদের এ ধরনের আচরণে অনেক চিকিৎসকও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, জ্বর-সর্দি, কাশি হলেই করোনা আক্রান্ত হতে পারেন এই ভয়ে চিকিৎসকরা দিচ্ছেন না চিকিৎসা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, বর্তমানে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কিন্তু আমরা প্রস্তুতির ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। করোনা টেস্টে গতকাল ৫১৩ জন বলা হলেও এতোদিন কেন বাড়ানো হলোনা? একই সঙ্গে যদি আক্রান্ত দেশ থেকে আসা সাড়ে ৬ লাখ মানুষকেই পরীক্ষা করা হতো, তাহলে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা জানা যেত। তিনি বলেন, দেশ করোনামুক্ত রাখতে প্রবাস ফেরত সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা প্রয়োজন ছিল।

এদিকে চিকিৎসকদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে গতকালই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আমরা লক্ষ্য করছি, আমাদের কিছু প্রাইভেট হাসপাতাল, সেখানে কাজ কম হচ্ছে। ক্লিনিক ও চেম্বারগুলো অনেকাংশে বন্ধ আছে। আমরা সামাজিক মাধ্যমে জানতে পারছি। আমরা নিজেরাও দেখতে পাচ্ছি। কাজেই এই সময়ে আপনাদের পিছপা হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। মানুষের পাশে দাঁড়ান। মানুষকে সেবা দেন। এটাই সময়। আমরা কিন্তু এটা লক্ষ্য করছি। পরবর্তীকালে এ বিষয়ে অবশ্যই যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার আমরা কিন্তু সে ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবো না।

সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ ইনকিলাবকে বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে এসেছে। তিনি চিকিৎক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচানা করে সব চিকিৎসককে রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।

সূত্র মতে, বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। এরপর থেকে আস্তে আস্তে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য করোনা একটি ভীতিকর বিষয়ে পরিণত হয়। এরপরই বেসরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সর্দি-জ্বরের চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়। এখন হৃদরোগ, এ্যাজমা রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে না। ডাক্তাররা পিপিই ছাড়া চিকিৎসা দিতে অপারাগতা প্রকাশ করেন। যদিও পিপিই ছাড়া চিকিৎসা আসলেই অসম্ভব।

প্রথম রোগী শনাক্তের পর হাসপাতালগুলোতে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে নামীদামী বেসরকারি হাসপাতালগুলো সীমিত আকারে তাদের চিকিৎসা চালাচ্ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের হয়রানি নজিরবিহীন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, করোনার পাশাপাশি এই স্বাস্থ্যসেবার সঙ্কটের বিষয়টিতেও অবিলম্বে প্রদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অন্যথায় করোনা ছাড়াই কেবল চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে পারেন অনেক মানুষ।

তবে পরিস্থিতিতে বিচলিত করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি (স্বাচিপ) প্রফেসর ডা. ইকবাল আর্সলান বলেছেন, আমি হাসপাতালের পরিস্থিতি কিভাবে পরিবর্তন করা যায় তা নিয়ে ইতোমধ্যেই কথা বলেছি। মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদায়ের সঙ্গেও কথা বলছি। আসলে করোনার আতঙ্ক থেকে এই অবস্থা। দরকার চিকিৎসকদের কাউন্সেলিং। এটা করতে পারলে ভালো হতো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে চিকিৎসক সমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। যার প্রভাবে হাসপাতাল ও ক্লিনিক হয়ে পড়েছে রোগীশূন্য। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বন্ধ রেখেছেন প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা। হাসপাতালে দায়িত্ব পালনরত অনেক চিকিৎসকই রোগী দেখতে ভয় পাচ্ছেন। এমনকি চিকিৎসক পরিবারের রোগীদেরও হচ্ছে না প্রয়োজনীয় চিকিৎসা।

করোনা আক্রান্ত রোগী এসেছেন কিংবা করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন এমন সন্দেহে হাসপাতাল ছেড়ে ডাক্তারের পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। গত কয়েকদিনে যেসব হাসপাতালে করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগী মারা গেছেন তার প্রায় প্রত্যেকটি হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স এমনকি রোগীশূন্য হয়ে পড়েছে। বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। দিন দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, করোনা সংক্রমণের ভয়ে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী নেই বলে অনেক চিকিৎসক রোগী দেখছেন না। সর্দি, জ্বর, হাঁচি, কাশি থাকা রোগীদের সরকারি হাসপাতাল থেকে বেসরকারি হাসপাতালে আবার বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রাইভেট চেম্ব্বারও বন্ধ রয়েছে। কোনো কোনো চিকিৎসক জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেবেন না বলেও লিখে রেখেছেন। বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনের কারণে জ্বর বা শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত অনেক রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এতে অনেক রোগী বিনা চিকিৎসায় আরও মুমূর্ষু হয়ে পড়ছেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে তারা চিকিৎসা করছেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিষয়টিকে আমলে নিয়েছে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ)। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব ডা. জাকির সুমন বলেন, যে চিকিৎসক বা হাসপাতাল সেটি সরকারি হোক বা বেসরকারি, রোগীর চিকিৎসা করবে না বা ভর্তি নেবে না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি, এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের অপেশাদারমূলক আচরণ পরিহার করার অহ্বান জানান।

এদিকে গতকাল এক বিবৃতিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে চিকিৎসা না পেয়ে রোগীর মৃত্যু ও ভোগান্তিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আসক বিবৃতিতে বলেছে, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোন এখতিয়ারে রোগী ভর্তি করছে না বা রোগীকে সেবা প্রদান থেকে বিরত থাকছে- সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সারাবিশ্বে এ মহামারীর চিকিৎসা প্রদানে হাসপাতাল প্রশাসন, ডাক্তার ও নার্সদের অবদান ও ত্যাগ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে শুরু থেকেই এ ক্ষেত্রে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করছে।

https://www.dailyinqilab.com/article/280564/