করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সারা দেশে চলছে ছুটি। একটু ত্রাণ বা অর্থ সহায়তার আশায় দুস্থ মানুষ এই ভিড়। ছবিটি গতকাল বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে তোলা -সংগ্রাম
৩ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার, ১:৫৯

গরিবের কান্না মধ্যবিত্তে হাহাকার

* আতংকের চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা বেশি

স্টাফ রিপোর্টার: করোনা ভাইরাসের কারণে সারাদেশে ঘরবন্দী জীবনযাপন করছে মানুষ। কিন্তু খেটে খাওয়া, ছিন্নমূল, দরিদ্র, দিনমজুরদের টানা এক সপ্তাহ আয়ের পথ বন্ধ থাকায় অভাব অনটনে দিশেহারা তারা। আয় না থাকায় অনেক মধ্য বিত্ত পরিবারে দেখা দিয়েছে হাহাকার। অনেকে আত্মীয় স¦জনের কাছে ধার দেনা চেয়ে বিমুখ হচ্ছেন। এসব পরিবার না পারে সাহায্য চাইতে না পারছে সংসার ব্যয় মেটোতে ফলে বেশী কষ্টে আছে এরা। অপর দিকে অনেক গরিব পরিবারে খাদ্যের অভাবে কান্না শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে এরা যত সামান্য খাদ্য পেলেও তা দিয়ে পুরো পরিবারের পেটের খাবার জোটে না।

এদিকে সরকারের দেয়া ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। তবে একটি জেলায় যে পরিমাণ বরাদ্দ হয়েছে তার চাইতে কয়েশ গুণ রয়েছে অভাবী মানুষ। ফলে কে পাচ্ছে আর কে পাচ্ছে তা বলা মুশকিল। এরই মধ্যে ত্রাণের চাল আত্মাসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে অনেক ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। ত্রাণের চাল আত্মসাৎ করার খবর প্রকাশ করার ভোলায় এক সাংবাদিককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে চেয়ারম্যানের ছেলে। নাবিল নামের ঐ অভিযুক্তকে বুধবার গ্রেফতার করেছে। লক্ষ্মীপুরে ইউপি চেয়ারম্যানের ত্রাণের চাল আত্মসাৎ করার অভিযোগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে রায়পুর যুবলীগ নেতা মামুন। তিনি লিখেছেন, প্রতিইউনিয়নে চাল বরাদ্দ ২টন। কিন্ত বিতরন করা হচ্ছে ৫শ’ কেজি।

এদিকে ত্রাণ বিতরণের অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি হলে কাউকে ছাড়বেন না মঙ্গলবার এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, মানুষের দুঃসময়ে কেউ সুযোগ নিলে তাকে আমি ছাড়বো না।

এদিকে শহর এবং শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে মানুষেরা এখন খাবারের সন্ধানে ভিড় করছে। কোথায় ত্রাণ কিংবা খাবার দেয়া হচ্ছে তা নিতে চেষ্টা করছে তারা। বিশেষ করে ঘরবন্দী মানুষের গৃহকর্তা কিংবা অভিভাবক ছুটছেন খাবার যোগাড় করতে। রাজধানী ছাড়াও জেলা শহরের কিংবা শহতলীর এ দৃশ্য সব সময়ের।

বস্তিতে বসবাসরত দিন আনে দিন খায়-আয়ের হাজার হাজার পরিবারের মানুষেরা পড়েছে আরো বিপাকে। কাজ বন্ধ থাকায় আয় উপার্জন একেবারেই শূন্যে নেমে আসায় কয়েকদিন ঘরে থাকলেও এখন অনেকে আর ঘরে বসে থাকতে পারছে না। অনেক রিকশাওয়ালা, অটোওয়ালা রাস্তায় নামলেও যাত্রীর অভাবে এক মোড় থেকে অন্য মোড়ে ঘুরে ঘুরে হতাশ।

এদিকে জেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ থেকে সাধ্যমত গরিব ও দিনমজুরদের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ শুরু করেছে। এ ছাড়া বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও জেলার অসহায় পরিবারের মাঝে বিতরণের জন্য টাকা কিংবা খাদ্য সামগ্রী জেলা প্রশাসকের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

আছমা থাকেন সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়ে। স্বামী তাকে ছেড়ে গেছেন দুই বছর আগে। ভাঙারি জিনিসপত্র কুড়িয়ে এনে বিক্রি করতেন। এতে যা সামান্য টাকা আসতো, তা দিয়ে পাঁচ ও সাত বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে চলাই ছিল মুশকিল। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ হলো, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া জনসাধারণের বাইরে বের হওয়াতে জারি হলো নিষেধাজ্ঞা। এতে ‘দিন আনে দিন খাওয়া’ আছমার উপার্জন বন্ধ হয়ে গেলো একেবারেই। গত ২৬ মার্চ থেকে সবকিছু বন্ধ হওয়ার পর দুদিন কোনও রকম সংসার চললেও এখন আর চলছে না। বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছেন আছমা সাহায্যের প্রত্যাশায়। বুধবার লিংরোডের সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পাশে এমন আশাতেই তিনি বসেছিলেন। শুধু তিনিই নন, সাহায্য পাওয়ার আশায় এমন আরও অন্তত ত্রিশজনের দেখা মিললো সেখানে। তারা বলছেন, ‘কাম (কাজ) নাই, রোজগার নাই, খামু কী?’

সাইনবোর্ড এলাকায় কয়েকটি বাসায় কাজ করতেন শাহিনা। মার্চ মাস শেষ হওয়ার আগেই বাসাগুলোতে কাজে না যেতে বলে দেয়া হয়েছে। গত ১০-১৫ দিন ধরে কাজ নেই তার। স্বামী কিছু করেন না। সংসারে রয়েছে চার বছরের এক মেয়ে। খাবার পাওয়ার আশায় তার মতো আরও সাত-আটজনকে বসে থাকতে দেখা যায় নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া মোড়ে।

মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় মেট্রো হলের সামনে দেখা মিলে একদল ভবঘুরের। তারা আশপাশের ফুটপাতে কিংবা রেলেেস্টনের থাকেন। চলেন প্লাস্টিক কুড়িয়ে। মার্কেট খোলা থাকলে মানুষের কাছ থেকে খাবার চেয়ে নেন। এখন সব বন্ধ। তাদের খাবারও বন্ধ। কেউ যদি এসে সাহায্য দিয়ে যায়, সেই প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন তারা।

তবে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজধানীতে ‘কার্যত লকডাউন’ সময়ে অসহায় মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন অনেকেই। তাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ জনগণ।

পুলিশের একটি গাড়ি থেকে এক প্যাকেট খিচুড়ি পেয়ে বেজায় খুশি কুলসুম ও রাবেয়া। রায়েরবাজারে বসবাস করলেও খাবার হাতে পেয়ে ধানমন্ডি-২৭ নম্বর সড়কের ফুটপাতে বসেই খেয়ে নিচ্ছিলেন তারা। রাতের খাবারের ব্যবস্থা হলেও সকালে কী খাবেন তা অনিশ্চিত জানান কুলসুম। তিনি বলেন, ‘এহনতো খাইলাম, সকালে কী খামু, জানি না?

এদিকে মতিঝিল একটি প্রাইভেট কম্পোনীতে নিন্ম পদে কাজ করে না নাম না প্রকাশ না করা শার্তে তিনি জানান, মধ্যবিত্ত পরিবারে হাহাকার দেখা দিয়েছে। যারা মানসম্মান হারানোর ভয়ে কারো কাছে কিছু চাইতে পারেনা। করোনা ভাইরাসের দুর্যোগে পড়ে তাদের সংসার জীবনেও দুর্যোগ নেমে এসেছে।

এদিকে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় মানুষ যখন কূলহারা, তখন এ মানুষদেরই কেউ কেউ হিংসা, স্বার্থের পরিচয় দিচ্ছেন বিবেকহারা হয়ে। উত্তরায় করোনা রোগীদের জন্য কোয়ারেন্টাইন সেন্টার বানাতে বাধা এলো, খিলগাঁওয়ে কবরস্থানে করোনা রোগীর লাশ দাফনে বাধা এলো। বাধা এলো আকিজ গ্রুপের হাসপাতাল নির্মাণেও। করোনার প্রভাবের সুযোগ নিয়ে দ্রব্যমূল্যও বাড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকে।

গবেষক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান গণমাধ্যমকে বলেন, মানুষ যদি মানবিক হতে না পারে তাহলে এই মহাদুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। মানুষের দায়টা বুঝতে হবে। সচেতনতার নামে অন্যের অধিকার হরণ করে আসলে ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকতে হলে সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হয়।

তিনি বলেন, এমন সময়ে সবার আচরণে ভালোটাই প্রকাশ করা জরুরি। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে দেখছি। আবার হিংসা, জুলুমও দেখছি। আমি মনে করি, সহিষ্ণু মনোভাব প্রকাশ করেই এই মহামারি মোকাবিলা করতে হবে।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেন, করোনার প্রভাবে মানুষ যত আপন হচ্ছে, তা আগে ঠিক দেখা যায়নি। সবাই সবাইকে দূরে রাখছে, অথচ মানবিকবোধটা জাগ্রত রেখেই। এ এক নতুন পৃথিবী যেন।

তিনি বলেন, মানুষের অসহায়ত্বের এমন দিনেও কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করলাম। কেউ কেউ নিজে বাঁচার চেষ্টা করছে। লাশ দাফনে বাধা মিলছে। এটি রীতিমত অবাক করেছে। মানুষ প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নেয় না, এটিই তার প্রমাণ। অথচ সমাজ পচে গেলে কেউ রক্ষা পাব না।

 

লেখক, গবেষক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, করোনা ভাইরাসের কাছে বিশ্ব ধীর ধীরে পরাস্ত হচ্ছে। মানুষের যেন আসলে কিছুই করার নেই। কত চেষ্টা জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে, অথচ লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে।

এই গবেষক বলেন, এই একটি রোগের কারণে মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ছে ঠিক, কিন্তু সামাজিক এবং মানবিকবোধ জাগ্রত করার সুযোগও এসেছে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসার সুযোগ পেয়েছে। মানুষ হিসেবে মানুষের যে দায়, তা উপলব্ধি করার সময় এসেছে। অথচ এমন সময়েও মানুষকে স্বার্থপর হতে দেখছি। হাসপাতাল করতে না দেয়া, লাশ দাফনে বাধার মতো ঘটনা মানব ইতিহাসে অসভ্যতা। এই আচরণ কোনো মানুষের হতে পারে না।

http://dailysangram.info/post/412245