৩১ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১১:২৯

রাজধানীর সড়কে বাড়ছে মানুষ ও পরিবহন চলাচল

মুহাম্মদ নূরে আলম : রাজধানীর সড়কগুলোতে গত ক’দিনের তুলনায় মানুষ ও পরিবহন চলাচল বেড়ে গেছে। এদিকে করোনা সচেতনতায় রাজধানীর ভাটারা এলাকায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), পুলিশ এবং সেনাবাহিনী। একই সময়ে সাম্প্রতিককালে বিদেশ থেকে আসা বাংলাদেশী নাগরিকেরা হোম কোয়ারেন্টিন নির্দেশনা মানছেন কিনা সে বিষয়েও তদারকি করে যৌথবাহিনী। করোনা ভাইরাসের বিস্তাররোধে ১০ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশনা দিলেও ৫ম দিনেই অনেকে নিজ নিজ প্রয়োজনে ব্যক্তিগত পরিবহন নিয়ে বেরিয়ে গেছে। রাস্তায় চারজনের বেশি একত্রে ঘুরাফেরা করতে নিষেধ করলেও কেউ লকডাউন মানছে না। যে যার মতো ইচ্ছে মতো ঘুরাফেরা করছে কিংবা কেউ রাস্তার উপরে বসে গল্প করছে। রাস্তায় বেড়েছে মানুষ চলাচলের সংখ্যাও। বেড়েছে মোটরসাইকেল এবং প্যাডেলচালিত রিকশাও। সেসব বাহনে চড়ে গন্তব্যে ছুটছে লোকজন। যদিও বেশিরভাগ লোকের মুখেই মাস্ক দেখা গেছে।

এদিকে করোনা ভাইরাস সচেতনতায় গতকাল সোমবার ডিএনসিসির বর্ধিত এলাকা অঞ্চল-৯ আওতাধীন ভাটারা থানার নতুন বাজার, খিলবাড়ি টেকসহ আশপাশের এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এতে সিটি করপোরেশনের পক্ষে নেতৃত্ব দেন অঞ্চল-৯ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (আনিক) হেমায়েত হোসেন। সেনাবাহিনীর দলে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন মাহমুদুল হাসান এবং পুলিশের দলের নেতৃত্ব দেন ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তারুজ্জামান। এসময় এলাকার বিভিন্ন অলিগলি, আবাসিক এলাকা এবং বাজার আছে এমন স্থানে নগরবাসীদের মধ্যে সচেতনতামূলক বার্তা সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করা হয়। হ্যান্ড মাইকিংয়ের মাধ্যমে এলাকাবাসীকে যথাসম্ভব ঘরে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়। খুব প্রয়োজনে বাইরে বের হলেও মাস্ক, গ্লাভস পরে নিজেদের মধ্যে অন্তত দুই মিটার সামাজিক দূরত্ব মেনে অবস্থান করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এসব এলাকায় সম্প্রতি যারা বিদেশ থেকে এসেছেন এবং যাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা আছে তারা সেটি মানছেন কিনা সে বিষয়েও তদারকি করে যৌথবাহিনী।

রাজধানীর মুগদা, বাসাবো, খিলঁগাও, মালিবাগ, মগবাজার, গাবতলী, কাজীপাড়া, শ্যামলী, আসাদগেট, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, অন্যান্য দিনের চাইতে গতকাল সোমবার সরকারি ছুটির ৫ম দিনে রাস্তায় মানুষষের চলাফেরা ও ব্যক্তিগত পরিবহনের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। বিশেষ ছুটির মধ্যেও জীবিকা অর্জনের জন্য মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বা পায়ে হেঁটে বেরিয়েছে। তবে করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদে থাকতে কারও কারও মুখে মাস্ক পরা দেখা গেছে। গণপরিবহন না পেয়ে অনেককে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে ছুটতে দেখা যায়। কয়েকটি পয়েন্টে দেখা গেছে, বাসস্ট্যান্ডে ভাড়ার জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, রিকশা ও প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষ ভাড়ায় এসব পরিবহনে নিজের গন্তব্যে যাচ্ছে।

কি করবো, খেতে তো হবে। জীবন তো আর থেমে থাকে না। তাই বাজার করতে বাসা থেকে বের হওয়া। করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের সময়ে ঘরে থাকার নির্দেশনার মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাজার করতে আসা এক বেসরকারি চাকরিজীবী এমন মন্তব্য করেন। শুধু ওই চাকরিজীবীই নয়, যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালীতে (বউ বাজার) কাঁচাবাজারে অনেক জনসাধারণকে বাজার করতে দেখা গেছে। কিন্তু সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না। যদিও সবার মুখেই মাস্ক দেখা গেছে। মোটা দাগেই ক্রেতাদের এটাই সচেতনতা। অপরদিকে সব দোকানি মাস্ক পরলেও আবার কাউকে কাউকে হ্যান্ড গ্লাভস পরতে দেখা গেছে। এ ছাড়া মহল্লার ভেতরে যুবক থেকে বৃদ্ধ অনেককে আড্ডা দিতে দেখা গেছে। বিশেষ করে চা দোকান বা রাস্তার মোড়ে এসব আড্ডা বেশি।

মুগদা এলাকার সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষারত হোসেন মিয়া বলেন, পেটের দায়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। ঘরে বসে থাকলে কেউ খাবার দিয়ে যাবে না, মাস শেষে বাড়ি ভাড়া দিতে হবে। পরিবারের খরচ তো আর বন্ধ থাকছে না, এ কারণে সকাল ৭টায় সিএনজি নিয়ে বের হয়ে ৪০০ টাকা আয় করেছি। রাত পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে যা আয় হয় তা নিয়ে বাড়ি ফিরব।

মালিবাগ বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমান ভাড়ায়চালিত অটোরিকসা চালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, করোনা ভাইরাসের ভয় নিয়েই বের হয়েছি। বাড়ি ভাড়া দেয়ার সময় হয়েছে, সংসারে স্ত্রী ও দুই সন্তানের ভরণ-পোষণ করতে হয়। ঘরে বসে থাকলে সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে সকাল ৮টায় বের হয়েছি। এ পর্যন্ত ৩০০ টাকা আয় হয়েছে, সন্ধ্যা পর্যন্ত আয় করে বাসায় ফিরব। পাশেই শামীম নামে এক রিকশা চালক জানান, সরকার সব বন্ধ ঘোষণা করলেও প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রিকশা চালান তিনি। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ টাকা আয় করে বাসায় ফিরছেন। পেটের দায়ে করোনা ভাইরাসের ভয় নিয়ে প্রতিদিন ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে তাকে।

চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত করোনা ভাইরাসের বিস্তাররোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গণপরিবহনও। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের এ ভাইরাসকে ঠেকাতে দেশবাসীকে ছুটির এ সময়ে ঘরে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছে সরকার। সেজন্য রাস্তায় র‌্যাব-পুলিশের পাশাপাশি তৎপর সশস্ত্র বাহিনীও। করোনা ভাইরাসে দেশে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৪৮ জন। মারা গেছেন ৫ জন।

গত রোববার বেসরকারি চাকরিজীবী মুহাম্মদ ইয়াছিন জানান, রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা মোতাবেক বাসাই থাকি। একান্ত দরকারেই বাজার করতে বের হয়েছি। কারণ আমি কোনো প্রকার খাদ্য সামগ্রী মজুদ করিনি। তাই মাঝে মধ্যে বাজার করতে বের হই। কি করবো, খেতে তো হবে। জীবন তো আর থেমে থাকে না। তাই বাজার করতে বাসা থেকে বের হওয়া। বাজারে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম মোটামুটি। সরবরাহ কম, ক্রেতাও কম। তবে কালোজিরা কিংবা লেবুর দাম অনেক বাড়তি। সব ক্রেতাই এ দু’টি নিতে ব্যস্ত। তাই হয়তো দাম বেশি।

পেঁয়াজ-রসুনের দোকানে দেখা মিললো আইনজীবী এম কে ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, সচেতনতা ভালোই দেখতেছি। সবার মুখে মুখে মাস্ক। কিছু দোকানির হাতে গ্লাভস। এটি ভালো। কিন্তু রাজধানীর বাসিন্দা হিসেবে যতটুকু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিত তা বেশির ভাগ মানুষ মানছে না। এক দোকানে চার/পাঁচজন মানুষ বাজার করছে।

এদিকে ভাটারা এলাকার করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সচেতনতা অভিযানের সার্বিক বিষয়ে অঞ্চল-৯ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (আনিক) হেমায়েত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, এটা আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম। এই সময়ে আমরা চাই নাগরিকেরা যেন যথাসম্ভব ঘরে থাকেন। এরপরেও কিছু মানুষ বের হচ্ছেন। প্রধান সড়ক বা রাজপথ সংলগ্ন জায়গাগুলোতে লোকজন বেশি ঘরে থাকার বিষয়টি মেনে চলছেন। কিন্তু এলাকার একটু ভেতর দিকে গেলে বোঝা যায় যে, অনেকেই ঘরে থাকছেন না। যেমন আপনারা এই এলাকায় (খিলবাড়ি টেক) দেখছেন কত মানুষ ঘরের বাইরে। আমরা তাদের বোঝাচ্ছি। সচেতন করার চেষ্টা করছি। এই সময় একটু ধৈর্য, সচেতনতা ও ঘরে থাকার থেকে ভালো কোনো ওষুধ নেই। হেমায়েত হোসেন আরও বলেন, নাগরিকেরা ঘরে থাকবেন। যারা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল নন আমরা তাদের খাদ্যসামগ্রী দেবো। ইতোমধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের ৫০০টি করে এবং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলরদের ১০০টি করে অসচ্ছল, অসহায় পরিবারের তালিকা করতে বলা হয়েছে। আমরা তাদের খাদ্যসামগ্রী দেবো।

এদিকে হোম কোয়ারেন্টিন তদারকির বিষয়ে ভাটারা থানার ওসি মোক্তারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাছে একটি তালিকা আছে যে কারা সম্প্রতি বিদেশ থেকে এই এলাকায় এসেছেন, এখানকার বাসিন্দা। কাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা আছে। সেই তালিকা ধরে ধরে আমি প্রতিদিনই সর্বোচ্চ সংখ্যক বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিষয়টি তদারকি করছি। আপনারা দেখেছেন আমরা আজ একটি বাড়িতে গেলাম যেখানে কাতার থেকে উর্মিলা শহিদ নামে এক নারী ফিরে এসেছেন। আমরা তার বাবা শাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি (উর্মিলা) হোম কোয়ারেন্টিন মানছেন কিনা, তাকে একটি ঘরে রাখা হয়েছে কিনা এবং তার সঙ্গে কেউ মেলামেশা করছে কিনা সে বিষয়টি দেখছি। আবার শুধু তাদের কথা না, আশপাশের দোকানদার বা এলাকাবাসীর থেকেও তথ্য নিচ্ছি যে, হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা আছে এমন ব্যক্তি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কিনা।’

http://dailysangram.info/post/411855