৩০ মার্চ ২০২০, সোমবার, ১২:৪৯

ছোট ব্যবসায়ীরা বড় বিপদে

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: করোনা ভাইরাসে স্তব্ধ গোটা বিশ্ব। দেশে করোনা রুখতে সাধারণ ছুটি চলছে। বন্ধ রয়েছে যাবতীয় যান চলাচল, দোকান-পাট সব। মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। ঘরের বাইরে চলাচলে দেয়া হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এমন অবস্থায় মহা বিপাকে পড়েছেন ছোট ব্যবসায়ীরা।

কিন্তু করোনা সংকটে চিন্তায় কপালে ভাজ পড়েছে তাদের। এরই মধ্যে সব অর্ডার বাতিল। বেতন, ভাড়া ও ইউটিলিটি বিল মিলিয়ে মাসে খরচ তার সাড়ে তিন লাখ টাকারও বেশি। এখন ব্যবসা বন্ধ হলে এই খরচ কি করে যোগাবেন জানা নেই তাদের। আগের যেসব অর্ডার ছিল সেগুলোর জন্য ফিনিশড প্রডাক্ট তৈরি করে রাখা, পাশাপাশি ঈদকে সামনে রেখে অনেক বাড়তি কাঁচামালও কিনে প্রক্রিয়াজাত করে রেখেছেন। এগুলো এখন বিক্রির কোন উপায় নেই।

২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ ও নীতি সহায়তা দিয়েছে এসএমই ফাউন্ডেশন, যাদের মধ্যে ১৮ হাজারই নারী। কিন্তু যারা একেবারেই নতুন অথবা ব্যবসার জন্য বড় ধরনের ঋণ করেছেন তারা পড়েছেন আরও বিপাকে।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম জানান, শো-রুম আর কারখানা মিলিয়ে মাসে খরচ ২ লাখ টাকা। ঈদকে সামনে রেখে প্রায় ৬৫ লাখ টাকার কাপড় ও কাঁচামাল কিনেছেন তিনি। তার উপর ব্যবসার জন্য ব্যাংক ঋণ আছে ২২ লাখ টাকা। যার জন্য প্রতিমাসে তাকে পরিশোধ করতে হয় ৫২ হাজার টাকা। কারখানা, শো-রুম সবই এখন বন্ধ কিন্তু মাস শেষে এগুলোর ভাড়াতো পরিশোধ করতে হবে। ব্যাংকের কিস্তি জুন পর্যন্ত দিতে হবে না, কিন্তু সুদতো গুনতে হবে। সরকার যদি এ সময় পর্যন্ত আমাদের ঋণের সুদটাও মৌকুফ করতো তাহলেও একটা বড় বাঁচা বাঁচতাম।

এসএমই ফাউন্ডেশন বলছে, এমন সংকটে আগে কখনোই মোকবেলা করতে হয়নি বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের। ঋণের কিস্তি পরিশোধে ৩০ জুন পর্যন্ত ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ব্যবসাই যদি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় উদ্যোক্তার বাকি খরচ আসবে কি ভাবে, বলছিলেন, ফাউন্ডেশনের পরিচালক রাশেদুল করিম মুন্না। তিনি বলেন, এ সংকটে যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা টিকতে পারবে না তা অনেকটাই স্পষ্ট। উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি সমস্যায় পড়বেন শ্রমিক-কর্মচারিরাও। এজন্য এসএমই খাতের জন্য এখনই সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা উচিত।

তবে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা শুধুমাত্র এসএমই ফাউন্ডেশনের মধ্যেই সিমাবদ্ধ নয়। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক শুমারির তথ্য বলছে, দেশে মোট এসএমই ইউনিট আছে ৩৪ হাজার এবং সেখানে কর্মরত আছেন প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। এই বিশাল সংখ্যক মানুষকে কোন সহায়তা প্যাকেজের আওতায় আনা যে খুব সহজ কাজ নয়, এব্যপারে একমত সবাই।

গত বুধবারের ভাষণে প্রধামন্ত্রী রফতানিমুখী শিল্প খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিলের ঘোষণা দিয়েছেন। সেখানে স্পষ্টই উল্লেখ করা হয়েছে এ ধরণের শিল্পের শ্রমিক কর্মচারিদের বেতন ভাতা পরিশোধে এ অর্থ ব্যায় হবে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগের ব্যবসাই স্থানীয় বাজার কেন্দ্রীক। ফলে তাদের পক্ষে এ তহবিল থেকে সহায়তা পওয়ার সুযোগ কম।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, আমাদের সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে। তাই শুধুমাত্র সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদেরও উদ্যোগী হতে হবে বলে জানান, এফবিসিসিআই এর সাবেক সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও এখন অনেক সামর্থ্যবান আছেন। তাদেরকে নিয়ে আমরা ব্যবসায়ীরা যদি একটা তহবিল করতে পারি এবং কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ তা নির্ধারণ করে সহায়তা পৌঁছে দিতে পারি তবে এ সংকট মোকাবেলা করতে আমাদের তেমন সমস্যা হবে না। আর ব্যবসায়ীদেরও মনে রাখতে হবে আপনার শ্রমিক-কর্মচারি বাঁচলেই আপনার ব্যবসা বাঁচবে। তাই এই সংকটময় মুহূর্তে আপনি যা খান আপনার শ্রমিক-কর্মচারিও যাতে তা খেতে পারে সেই ব্যবস্থা করবেন।

এদিকে করোনা ভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় সারা দেশের সব স্তরের ব্যবসায়ীদের কমপক্ষে তিন মাসের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ ও কর মওকুফ চান দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিটল-নিলয় গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা আহমাদ এমপি। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সুদমুক্ত জরুরি ঋণ সুবিধা দিতে হবে।

নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ-বিডব্লিউসিসিআইর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সেলিমা আহমাদ বলেন, সারা দেশের নারী উদ্যোক্তাদের সব পর্যায়ের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ। করোনা ভাইরাসের আঘাতে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবেন নারী উদ্যোক্তারা। তাদের পাশে সরকারের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হোক।

তিনি বলেন, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে নিয়োজিত শিল্প-কারখানাগুলো তাদের পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করতে পারছে না। এমনকি ভোগ্য পণ্যের শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ রয়েছে। তারাও বিপদে পড়েছে। তাদের জন্যও সরকারের সহায়তা লাগবে। দেশীয় শিল্প খাত বাঁচাতে হবে।

দেশের এই শীর্ষ নারী উদ্যোক্তা বলেন, পয়লা বৈশাখ ও ঈদ ঘিরে সারা দেশের নারী উদ্যোক্তাসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এবার তারা বিপদে পড়েছেন। আবার এসব পণ্যের খুচরা বিক্রেতারাও বিপদে পড়েছেন। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। লেনদেন নেই। ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের পাশে সরকারের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এই সহযোগিতা কীভাবে করা যায়, তা এখনি ভাবতে হবে।

এছাড়া করোনা আতংকের মধ্যে যেসব প্রয়োজনীয় দোকান খোলা রয়েছে তাদেরও বেচা-কেনা হচ্ছে না। এমন অবস্থায় গত শুক্রবার বিকেলে নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়েছেন রাজধানীর মিরহাজিরবাগ কাঁচাবাজারের এক দোকানদার। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি হয় তার দোকানে। তবুও কোনো ক্রেতা নেই। স্বাভাবিক সময়ে শুক্রবারে ক্রেতাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। কিন্তু গত শুক্রবার হওয়া সত্ত্বেও সকাল থেকে বিক্রি হয়েছে সামান্যই।

তিনি জানান, বাসা ভাড়াসহ সংসারের সব খরচ দোকানের আয় থেকে হয়। এই দোকানের আয় দিয়েই তিনি সবদিক সামলান। কিন্তু এই ভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন তিনি। এমন যদি আরও অনেক দিন থাকে তাহলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে তার। আর যদি এই অবস্থা আরও বাড়ে তাহলে প্রচণ্ড বিপদে পড়তে হবে তাকে।

এমন অবস্থা শুধুমাত্র ওই দোকানদারের নয়, ছোট ছোট ব্যবসা করা সকলেরই। দোকান বা ব্যবসা বন্ধ থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেকে। এভাবে দুই চারদিন সামলাতে পারলেও বেশি সময় ধরে চললে কী হবে তা তারা জানেন না।

http://dailysangram.info/post/411729