২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১২:৫৯

ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামাঞ্চল

করোনায় রাজধানীর মানুষ গৃহবন্দি

করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে অঘোষিত লকডাউনে রাজধানীবাসী এখন কার্যত গৃহবন্দি। মহানগরীর ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান পাতলেই শোনা যায় ‘আপনারা দয়া করে ঘরে থাকুন। জরুরি কোনো কাজ না থাকলে ঘর থেকে বেরুবেন না’ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কবার্তা। রাজধানীর মানুষ সংক্রমণ এড়াতে কার্যত নিজেরাই বন্দিদশা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। দেশে ফিরে এসে প্রবাসীদের অধিকাংশই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। আত্মঘাতীর মতো তারা লুকিয়ে থেকে নিজেদের জীবনের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশিদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছেন। প্রবাসীদের সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে রাজধানীর ঢাকা থেকে গ্রামে বাড়িতে ফিরে যাওয়া লাখো মানুষ। ঢাকায় কিছু হাসপাতালে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশ জেলায় এখনো সে সুবিধা পৌঁছায়নি। ফলে গ্রামাঞ্চল হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ। বিদেশ এবং ঢাকা থেকে যারা গ্রামে গেছেন তাদের মধ্যে কে করোনাভাইরাস বহন করছেন কেউ জানেন না। ইতালি ও উত্তর কোরিয়ায় একজন বহনকারীর মাধ্যমে গোটা দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস ঠেকাতে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা অপরিহার্য।

গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। উন্নত সেবার পরও প্রতিদিন ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, আমেরিকায় শত শত প্রাণহানি ঘটছে। বাংলাদেশেও ক্রমান্বয়ে এর বিস্তার ঘটছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে মানুষকে ‘ঘরে’ রাখার প্রাণপণ চেষ্টায় প্রায় অচল হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। নাগরিকদের ঘরে থাকার নির্দেশনা এবং কয়েকদিনের ছুটিতে সুনসান রাজধানী। বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আগে অনেকে ঢাকা ছাড়তে পারলেও যারা রাজধানীতে রয়ে গেছেন তারা এখন ‘গৃহবন্দি’। অন্যদিকে টানা ১০ দিনের ছুটি পেয়ে স্রোতের মতো গ্রামে ছুটে গেছে হাজারো মানুষ। এতে তারা গ্রামাঞ্চলকে অনিরাপদ করে তুলেছেন। এখন গ্রামে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ১৮ ফেব্রæয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত চার লাখ ৩৯ হাজার ৯৫৩ দেশি-বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। এখন পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন মাত্র ৪৭ হাজার ৩৬১ জন। অর্থাৎ ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ মানুষ নিময় মেনে ঘরে থাকছেন। মাদারিপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, খুলনা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, ফেনী, রাজশাহী, যশোর, বরিশালসহ অধিকাংশ জেলায় বিদেশ ফেরতরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই সব জেলায় কিছু কিছু হোম কোয়ারেন্টইনে প্রবাসীরা থাকলেও বেশির ভাগ কোথায় রয়েছেন তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জনরা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে জানিয়েছেন, তালিকায় থাকা বিদেশফেরত বেশিরভাগ ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বিদেশফেরতরা ঠিকানা হিসেবে যেসব স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন, সেখানে গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। তারা অন্যত্র থাকছেন। মজার বিষয় হলো যে সব প্রবাসী আত্মগোপন করে পালিয়ে রয়েছেন বা অন্যত্র আছেন তাদের স্থানীয় থানায় রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। প্রশাসনের এই হাস্যকর নির্দেশনা গ্রামের মানুষের মধ্যে হাসির খোড়াক জোগারেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, রাজধানী ঢাকা থেকে গত কয়েকদিন যেভাবে ঠাসাঠাসি করে গ্রামে মানুষ ফিরে গেছেন, সেটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে, এক মিটার দূরত্বে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, সেখানে গাদাগাদি করে বিভিন্ন পরিবহনে মানুষ গ্রামে ফিরেছেন, সেটিতে আরও ঝুঁকি তৈরি করেছে। এসব মানুষ গ্রামে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বৈশ্বিক মহামারী রূপ পাওয়া কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশ লকডাউন ঘোষণার পর বাংলাদেশের এর সংক্রমণ এড়াতে আগেই বন্ধ করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপরও আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ হয়েছে বিপণীবিতান, গণপরিবহন ও আকাশ পথ। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিতে মাঠে নেমেছেন বাহিনীর সদস্যরাও।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত বৃহস্পতিবার থেকে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস ১০ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়। যাত্রীবাহী বাস, লঞ্চ ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেও বিকল্প পথে হাজারো মানুষ বাড়ি ফিরে গেছেন। বাস, ট্রেন ও লঞ্চে দেখা গেছে মানুষের স্রোত। কেউ খোলা ট্রাকে, কেউবা কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়ি, আবার কেউ পণ্যবাহী পরিবহনে করে গ্রামে ফেরেন। হাজারো মানুষ গ্রামে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য ছিল ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার মতো। সড়ক-মহাসড়কে ট্রাক-লরি ও পণ্যবাহী পরিবহনের দীর্ঘ জট। টাঙ্গাইল টু রংপুর সড়কে সৃষ্টি হয় ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহাসড়কে আটকে আছে তাদের বহনকারী যানগুলো। এতে করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই ছুটি ঘোষণা করা হয়, তা কতটুকু কাজে আসবে তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। আগে থেকে বিদেশ ফেরত ব্যক্তিরা গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছেন। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও বেশিরভাগ ব্যক্তিই তা মানছেন না। হোম কোয়ারেন্টাইনে না থেকে তারা সর্বত্র ঘোরাঘুরি করছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুযায়ী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়।

গত কয়েকদিনে গ্রামাঞ্চলে হোমে কোয়ারেন্টাইনের শর্ত না মানায় অনেকের জরিমানা করা হয়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে যাওয়ায় ঝুঁকির আশঙ্কা প্রকাশ করে জাতীয় রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ছুটি পেয়ে ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরা মানুষগুলো ঝুঁকি তৈরি করেছে। তাদের প্রতি আহŸান থাকবে, সবাই যেন বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত পুরোপুরি মেনে চলেন। পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী সবার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন। ঘরের মধ্যে পৃথকভাবে অবস্থান করেন। অন্যথায় রোগটি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে আমরা এই রোগটি মোকাবেলা করতে সক্ষম হবো। সুতরাং সবাইকে এই নির্দেশনাটি মেনে চলতে হবে।

বিশ্বের ১৭৫টি দেশে করোনাভাইরাস আক্রমণ করেছে। এর মধ্যে চীন এতোমধ্যেই পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নিয়েছে। আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, কোরিয়া, ইংলান্ডসহ কয়েকটি দেশে মৃত্যের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ (১০ শতাংশ) মানুষের করোনা সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ১ শতাংশ আক্রান্ত হলেও দেশের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার কোনো সক্ষমতা থাকবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে মোট ৪ হাজার ৫১৫টি আইসোলেশন বেড প্রস্তুত। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই প্রস্তুত করা হয়েছে ১ হাজার ৫০টি। ঢাকার মোট পাঁচটি হাসপাতালে এ ইউনিট গড়ে তোলা হয়েছে। এ পাঁচটি হাসপাতালে মোট ২৯টি ভেন্টিলেশন সুবিধা আছে। করোনা রোগীর চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে কোনো আইসোলেশন ইউনিটে কোনো ধরনের ভেন্টিলেশন সুবিধা দেয়া হয়নি। সরকারের এই হিসেব কার্যত প্রবাদের ‘কাজির গরু কেতাবে রয়েছে গোয়ালে নেই’ মতোই। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বর্তমানে সারাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছেন এমন অন্তত বয়স্ক মানুষ ৮০ লাখ। অথচ এর বিপরীতে ৫টি হাসপাতালে ২৯টি আইসিইউ বেড প্রস্তুতের কথা জানিয়েছে সরকার। সেগুলোও রাজধানী ঢাকায়। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসায় কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র (ভেন্টিলেটর) ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এ সুবিধা শুধু রাজধানীতেই। দেশের ৬৩ জেলায় ভেন্টিলেশন সুবিধা নেই। এ অবস্থায় গ্রামাঞ্চলে প্রবাসীদের অবাধ বিচরণ এবং ঢাকা থেকে গ্রাম যাওয়া গার্মেন্টস কর্মী ও সাধারণ মানুষের অবাধ চলাফেরা গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও করোনা প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, গ্রামে হাজারো মানুষ ফিরে যাওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের। তবে এখন তাদের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা প্রতিরোধে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, সেগুলোর যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ, বাড়িতে ফিরে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে দূরত্বে রাখতে হবে। ঢাকা থেকে যারা গ্রামে ফেরত গেছেন তাদের পৃথক কক্ষে অবস্থান করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখুন। অন্তত ১৪ দিন বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। এসব বিষয় না মানলে নিজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য মা-বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ প্রতিবেশী সবার জন্য ঝুঁকি তৈরি হবে। সর্বোপরি দেশের সবার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে নিজে নিরাপদ থাকুন, সবাইকে নিরাপদ রাখুন।

https://www.dailyinqilab.com/article/278781