২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১২:৫৫

করোনায় চাপের মুখে সামষ্টিক অর্থনীতি

রেমিটেন্স, আমদানি রফতানি ও রাজস্ব সূচকে নিম্নমুখী প্রবণতা * নিত্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী * কমবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি -এমকে মুজেরী

বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস মহামারী রূপ নেয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে সামষ্টিক অর্থনীতি। ইতোমধ্যেই কমেছে পণ্য আমদানি। কাঁচামালের সংকটে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধের উপক্রম হয়েছে। অপরদিকে সীমিত হয়ে আসছে পণ্য রফতানি।

বিজিএমইএর দাবি তাদের পৌনে ১৩ হাজার কোটি টাকার ক্রয়াদেশ স্থগিত করা হয়েছে। অনিশ্চয়তার কারণে কেনাকাটা বেড়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের ওপর চাপ বেড়েছে। ফলে পণ্যের এ মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে সহায়তা করবে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দায় রাজস্ব আহরণেও ঘাটতি পড়বে। ধাক্কা লেগেছে রেমিটেন্স খাতেও। সব মিলে পুরো সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে বলে অভিমত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেছেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে করোনার প্রভাব পড়বে। কারণ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। চীন থেকে পণ্য আসা কমেছে ২৬ শতাংশ। কাঁচামাল দেরিতে আসায় উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া পণ্য রফতানিতেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ বাস্তবতার সঙ্গে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. এমকে মুজেরী যুগান্তরকে বলেছেন, করোনার প্রভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপ আসছে।

কত বেশি চাপ সৃষ্টি হবে এটি নির্ভর করবে করোনা দীর্ঘায়িত হওয়ার ওপর। কারণ ইতোমধ্যে আমদানি ও রফতানি কমেছে। পাশাপাশি কাঁচামাল আমদানি হ্রাস ও সংকটের কারণে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এতে প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া রাজস্ব আয়ে ঘাটতি বাড়বে। ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক বলেছেন, করোনার প্রভাবে এ পর্যন্ত (২২ মার্চ) এক হাজার ৮৯টি কারখানার প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের (দেশি মুদ্রা ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার) ক্রয় আদেশ স্থগিত হয়েছে। বর্তমানে এ খাতটি গভীর সংকট পার করছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে গত অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে রফতানি আয় কমেছে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

এদিকে আমদানিও কমেছে। জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের জন্য জাহাজ আমদানি আগামী ৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া বন্দরে পণ্য আসার পরিমাণ ক্রমেই কমছে। স্বাভাবিক সময়ে ৪৯ হাজার টিইউএস ধারণ ক্ষমতার চট্টগ্রাম বন্দরে ৪৫ হাজার টিইউএসের বেশি কনটেইনার থাকত। আর সম্প্রতি সেটি ৩৪ হাজার টিইউএসে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেছেন, করোনা প্রভাবে জাহাজের সংখ্যা কমে গেছে এবং ক্রমান্বয়ে আরও কমছে। এর ফলে রাজস্ব আহরণ কমার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত অর্থবছরে ৮৭ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। সিপিডি মনে করছে, রাজস্ব আদায়ের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, করোনা ছাড়াই ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা হবে। এরপর করোনার কারণে এটি আরও বাড়বে এটি সহজেই বলা যায়।

করোনা পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের বাজারে চাপ বেড়েছে। সরকারি হিসাবেই এক মাসে সব ধরনের চালের মূল্য কেজিতে বেড়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। একসঙ্গে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় চাল-ডালসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি থেমে নেই। সব মিলিয়ে করোনায় মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, করোনা রোগী শনাক্তের পর দাম বৃদ্ধির প্রথম আঘাত আসে মাস্কের ওপর। ২০ টাকার মাস্কের দাম উঠেছে ২শ’ টাকা পর্যন্ত। আর টিসিবির হিসাবে গত এক মাসের ব্যবধানে খোলা আটা কেজিতে ২ টাকা, প্যাকেটজাত আটা ৩ টাকা, খোলা ময়দা ২-৩ টাকা এবং প্যাকেটজাত ময়দা ৩ টাকা বেড়েছে। এছাড়া ভোজ্যতেল লিটারে (খোলা) ৩ টাকা, বোতলজাত (১ লিটার) ৫ টাকা, লুজ পাম অয়েল লিটারে ৩ টাকা, পাম অয়েল সুপার ৪ টাকা বেড়েছে। এছাড়া মসুর ডাল কেজিতে ৫ টাকা, হলুদ ১০ টাকা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে আতঙ্কিত হয়ে কোনো পণ্য অতিরিক্ত ক্রয়ের প্রয়োজন নেই। চাহিদার কয়েকগুণ মজুদ আছে নিত্যপণ্যের। অন্য বছরের তুলনায় এবার মজুদের পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।

এদিকে রেমিটেন্সেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গত এক মাসে রেমিটেন্স কমেছে ১৯ কোটি ডলার। সংশ্লিষ্টরা জানান, চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া ভাইরাসটি ইতোমধ্যেই অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে বড় অঙ্কের রেমিটেন্স আসে- এমন দেশও রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালিতে ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হয়েছে। যে কারণে এ খাতে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, প্রবাসীরা কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। চাকরিচ্যুত কিংবা কর্মহীন হয়ে পড়বেন কিনা, সে কারণে অনেকে টাকা পাঠাতে চাইবেন না। আবার দেশে পাঠালেও সে টাকার অপব্যবহার হবে কিনা। এ ধরনের নানা সংশয়ে আছেন প্রবাসীরা। এদিকে একমাত্র কৃষিপণ্যের যথেষ্ট উৎপাদন ও মজুদ আছে। এখন পর্যন্ত ১৭ লাখ টন খাদ্য মজুদ রয়েছে। গত বছরের চেয়ে যা দেড় লাখ টন বেশি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/293337