২৮ মার্চ ২০২০, শনিবার, ১২:৫৩

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে করোনার ধাক্কা

কাজ হারানোর ঝুঁকিতে ৫ কোটি মানুষ

করোনাভাইরাসের ধাক্কা লেগেছে দেশের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। যেখানে দেশের মোট শ্রমশক্তির (কর্মে নিয়োজিত) ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ (৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার) মানুষ এ খাতে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক হওয়ায় এমনিতেই এ খাত প্রায় শ্রম অধিকারবঞ্চিত। এর ওপর করোনার প্রভাব দীর্ঘায়িত হলে সেখানে উদ্যোক্তারা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন। ফলে স্থায়ীভাবে এ বিশাল শ্রমশক্তি কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ব বিপর্যয় সৃষ্টিকারী করোনা বাংলাদেশেও ভয়ংকরভাবে এগোচ্ছে। এর অর্থনৈতিক ক্ষতি কত হবে, সেটি এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে ইতোমধ্যেই সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। এমনিতেই এ খাতের শ্রমিকরা বঞ্চনার শিকার। কোনো চুক্তি ছাড়াই কাজ করেন।

ফলে তাদের চাকরিতে সমস্যা হতে পারে। ব্যবসা, বাণিজ্য, উৎপাদন, আমদানি-রফতানি সব ক্ষেত্রেই অবস্থা খারাপ। এ পরিস্থিতিতে তাদের জন্য একটি সহায়তা প্যাকেজের পাশাপাশি বিশেষ তহবিল গঠন করা দরকার।

প্রয়োজনে যারা পরে কাজ পাবেন না তাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আনত হবে। এছাড়া দেশের ব্যাংকিং খাতের উচিত হবে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা। কেননা এ উদ্যোক্তারাই কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রধান খুঁটি। পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যাপকভিত্তিতে চলমান রেখে অর্থ প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। প্রকল্প থেকে আদর-আপ্যায়নসহ অযাচিত ব্যয় বাদ দিতে হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি করা সর্বশেষ ‘শ্রমশক্তি জরিপ’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের মোট শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৮ লাখ। এর মধ্যে মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি খাতের মোট শ্রমশক্তির (কর্মে নিয়োজিত) ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক। এছাড়া শিল্প খাতে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ আর সেবা খাতে শ্রমশক্তির ৭১ দশমিক ৮ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক।

ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে মোট অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন ৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ। এর মধ্যে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১ কোটি ৭১ লাখ ২১ হাজার জন আর পুরুষ রয়েছেন ৩ কোটি ৪৬ লাখ ১৩ হাজার। এছাড়া গ্রাম ও শহরের হিসাবও আলাদা করে দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, অপ্রাতিষ্ঠানি খাতে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বেশি কাজ করছেন। এ সংখ্যা হচ্ছে গ্রামে ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৪১ হাজার আর শহরে কাজ করেন ১ কোটি ৩০ লাখ ৯৩ হাজার মানুষ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি মানুষ ১ কোটি ৭৩ লাখ ২৯ হাজার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগে কাজ করছেন ৮৬ লাখ ৮৫ হাজার মানুষ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা রাজশাহী বিভাগে রয়েছেন ৮২ লাখ ৬৭ হাজার মানুষ। এরপর রংপুর বিভাগে ৬৬ লাখ ৮৩ হাজার, খুলনা বিভাগে ৫৪ লাখ ৪৪ হাজার, সিলেট বিভাগে ২৪ লাখ ৯৮ হাজার এবং বরিশাল বিভাগে ২৪ লাখ ২৮ হাজার মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কাজ হারানোর ঝুঁকি নয়, ইতোমধ্যেই তারা কাজ হারিয়েছেন। কেননা ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে গেছে। তারা গ্রামে চলে গেছেন। যারা ক্ষুদ্র কোনো কাজ করতেন বা কাজের বুয়া, রিকশাচালক, ছোট ছোট কারখানার কর্মী, মুদি দোকানের কর্মী, টেইলার্সের কর্মী, বিক্রয়কর্মী এরকম লোকজন। তাদের আয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর পরিস্থিতি উন্নতি হলে অনেকেই আগের জায়গায় কাজ ফিরে নাও পেতে পারেন। অর্থনীতির চাকা এখন বন্ধ। তাই এখনই এ শ্রেণির মানুষের জন্য নগদ টাকা সহায়তা ঘোষণা করা উচিত। তাদের ক্রয় ক্ষমতা ঠিক রাখতে দ্রুত এ উদ্যোগ নিতে হবে। পরে দীর্ঘ মেয়াদে কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেটি এখন না ভাবলেও চলবে। এখন জীবন ও জীবিকা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই স্বাস্থ্য বিবেচনায় জীবন রক্ষার জন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের লোকদের জন্য লাইফ সাপোর্ট হিসেবে সহায়তার আওতায় আনতে হবে।

বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির মধ্যে ব্যবস্থাপক পর্যায়ে কর্মরত রয়েছেন ৬ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৬৪ হাজার এবং পুরুষ ৫ লাখ ৯৭ হাজার। পেশাদার ১৯ লাখ ৪০ হাজারের মধ্যে পুরুষ সাড়ে ১২ লাখ এবং মহিলা ৬ লাখ ৯০ হাজার। প্রযুক্তি এবং তৎসংশ্লিষ্ট কর্মে ৭ লাখ ২৭ হাজারের মধ্যে পুরুষ ৬ লাখ ২১ হাজার এবং মহিলা ১ লাখ ৭ হাজার।

করণিক সহায়ক কর্মে ৫ লাখ ৩৭ হাজারের মধ্যে পুরুষ ৪ লাখ ৩৬ হাজার এবং মহিলা ১ লাখ ১ হাজার জন। সেবা এবং বিক্রয়কর্মী ৬১ লাখ ২৭ হাজারের মধ্যে পুরুষ ৫৪ লাখ ২৭ হাজার এবং মহিলা ৭ লাখ। দক্ষ কৃষি-বনায়ন ও মৎস্য খাতের ১ কোটি ৮৬ লাখ ৫০ হাজারের মধ্যে পুরুষ ৯৩ লাখ ৫০ হাজার এবং মহিলা ৯৩ লাখ। কারুশিল্প এবং এ সংশ্লিষ্ট কর্মে ৯১ লাখ ৫৯ হাজার মানুষ নিয়োজিত।

এর মধ্যে পুরুষ ৬১ লাখ ৬৬ হাজার এবং মহিলা ২৯ লাখ ৯৪ হাজার। উৎপাদক-যন্ত্র পরিচালনাকারী এবং সংযুক্তকরণের কাজে নিয়োজিত ৩৮ লাখ ৩১ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৩৪ লাখ ৫২ হাজার এবং মহিলা ৩ লাখ ৭৯ হাজার। প্রাথমিক পেশায় যুক্ত ১ কোটি ৮১ হাজারের মধ্যে পুরুষ ৭২ লাখ ৯৮ হাজার এবং মহিলা ২৭ লাখ ৮৪ হাজার। এছাড়া অন্যান্য পেশায় যুক্ত রয়েছেন ২১ হাজার মানুষ। এর মধ্যে পুরুষ ১৭ হাজার এবং বাকিটা মহিলা।

অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা এমনিতেই যে কোনো সময় কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে যেতে পারেন। ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান কমে গিয়ে দারিদ্র্য সীমার নিছে নেমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ বিশাল শ্রমশক্তি কম মজুরি ও কম উৎপাদনশীল। সংখ্যায় বিশাল হলেও এ শ্রমিকদের কর্মের নিরাপত্তা নেই, শ্রম আইনের বাইরে থাকায় তারা কোনো ধরনের শ্রমিক অধিকার পাচ্ছেন না। যে কোনো সময় ইচ্ছা করলেই তাদের কাজ থেকে বের করে দেয়া হতে পারে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) স্বীকৃত কোনো সুবিধাই জোটে না তাদের ভাগ্যে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/293328/