২৭ মার্চ ২০২০, শুক্রবার, ৪:১০

ওসি ও ডিউটি অফিসার বরখাস্ত

আমতলী থানায় আসামির ভাইয়ের রহস্যজনক মৃত্যু

পরিবারের অভিযোগ দাবিকৃত টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা

বরগুনা জেলার আমতলী থানায় হত্যা মামলার আসামির ভাই শানু হাওলাদারের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (তদন্ত) কক্ষ থেকে। বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৬টায় এ ঘটনা ঘটে। পরিবারের অভিযোগ ওসি আবুল বাশার ও ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রিকে ৩ লাখ টাকা না দেয়ায় তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে পুলিশ সুপার। গঠন করা হয়েছে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি। এদিকে নিহতের স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের লোকজন থানায় বসে বিলাপ করে বলছিলেন, ওসি আবুল বাশারকে অপসারণ না করা পর্যন্ত আমরা লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাব না।

জানা গেছে, গত বছর ৩ নভেম্বর উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের পশ্চিম কলাগাছিয়া গ্রামের ইব্রাহিম নামের এক কৃষককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই মামলার এজাহারে শানু হাওলাদারের সৎ ভাই মিজানুর রহমান হাওলাদারকে আসামি করা হয়। কিন্তু ওই মামলার পুলিশ শানু হাওলাদারকে সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় সহেন্দভাজন আসামি হিসেবে ধরে নিয়ে যায়। থানার ওসি আবুল বাশার ও ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি আসামির পরিবারের কাছে ৩ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন। কিন্তু টাকা দিতে অস্বীকার করে তার পরিবার। টাকা না পেয়ে আসামি শানু হাওলাদারকে থানা হাজতে রেখে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের নামে দফায় দফায় নির্যাতন করে। নিরুপায় হয়ে শানুর ছেলে সাকিব হোসেন মঙ্গলবার সকালে ওসি আবুল বাশারের হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দেয়। তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন। বুধবার পরিবারের লোকজন শানু হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও পুলিশ দেখা করতে না দিয়ে উল্টো পরিবারের লোকজনের সাথে অশ্লীল আচরণ করে তাড়িয়ে দেয় বলে অভিযোগ নিহতের ছেলে সাকিব হোসেনের। ওসি আবুল বাশারের দাবি, বৃহ¯পতিবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে আসামি শানু বাথরুমে যাওয়ার কথা বললে পুলিশ তাকে নিয়ে যায়। এক ফাঁকে শানু হাওলাদার ওসি (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রির কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

ঘটনা জানতে পেরে নিহতের স্বজন ও সংবাদ কর্মীরা থানার সামনে ছুটে আসে। ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে তাদের বাধা দেয়া হয়। পরে আধা ঘণ্টা পর পুলিশ ফটক খুলে দেয়। এ সময় থানার ভেতরে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। খবর পেয়ে বরগুনা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন দ্রুত আমতলী থানায় ছুটে আসেন। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) তোফায়েল আহম্মেদকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বরগুনা সদর) মহররম আলী ও সহকারী পুলিশ সুপার (আমতলী-তালতলী সার্কেল) সৈয়দ রবিউল ইসলাম।

এদিকে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১০টায় বরগুনা জেলার সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান ও আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা শংকর প্রসাদ অধিকারী নিহত শানু হাওলাদারের সুরতহাল করেন। দায়িত্বে অবহেলার দায়ে তাৎক্ষণিকভাবে বরগুনা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন মনোরঞ্জন মিস্ত্রি ও ডিউটি অফিসার এএসআই আরিফুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। শানু হাওলাদারের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে মর্গে পাঠানো হয়েছে। নিহতের ছেলে সাকিব হোসেন বলেন, বিনা অপরাধে আমার বাবাকে ওসি ধরে এনে তিন লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিল। দাবিকৃত টাকা দিতে অস্বীকার করায় আমার বাবাকে নির্যাতন করেছে। বাবার নির্যাতন সইতে না পেয়ে আমি মঙ্গলবার দুপুরে ওসিকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু ঐ টাকায় ওসি সন্তুষ্ট হয়নি। টাকার জন্য নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বারবার আমার কাছে টাকা দাবি করেন। তিনি বলেন, বুধবার সকালে আমি বাবার সঙ্গে দেখা করতে থানায় আসি। কিন্তু আমাকে দেখা করতে না দিয়ে ওসি ও ওসি (তদন্ত) আমাকে গালাগাল দিয়ে তাড়িয়ে দেন। সারাদিনে আমাকে বাবার সঙ্গে দেখা করতে দেননি। ওসি বলেন, টাকা নিয়ে আয়, তারপর দেখা করতে দেব। নিহত শানু হাওলাদারের শ্যালক রাকিবুল ইসলাম বলেন, দুলাভাইকে ধরে আনার পর থেকে আমি থানা প্রাঙ্গণে ছিলাম। পুলিশ তাকে টাকার জন্য বেধড়ক মারধর করেছে। তার চিৎকার শুনেছি। বহুবার চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে দেখা করতে কিন্তু পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। শানু হাওলাদারের স্ত্রী ঝরনা বেগম বলেন, পাঁচজন পুলিশ যাইয়্যা সোমবার রাইতে মোর স্বামীরে বাড়ি থেকে ধইর‌্যা আনছে। আনার সময় মোর কাছে টাকা চাইছে। মুই টাকা দেতে রাজি অই নাই হেইয়্যার লইগ্যা মোর স্বামীকে পুলিশে পিডাইয়্যা মাইরা হালাইছে। মুই স্বামী হত্যার বিচার চাই। থানার ভেতরে ঝরনা বেগম এই বিলাপ করে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল। গুলিশালালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম বলেন, শানু হাওলাদারকে বাড়ি থেকে ধরে এনে নির্যাতন করেছে পুলিশ। আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের সাজানো। আমতলী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, থানার ওসি আবুল বাশার টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে শানুকে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার দাবি করছি। আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ স¤পাদক পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, পুলিশ পরিকল্পিতভাবে শানুকে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এ ঘটনার বিচার দাবি করছি। বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ৩ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/293098/