১০ মার্চ ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:৩৫

রূপপুর বালিশকাণ্ড: জামিন পেতে নতুন ‘ফন্দি’ আসামিদের

নিম্ন আদালতে তিনবার জামিন নাকচ * ১৩ জনের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান হচ্ছে * তৎকালীন মন্ত্রীর কোনো দায় আছে কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে

রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের বালিশকাণ্ডে জড়িত গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলমসহ ১৩ জন আসামি নিম্ন আদালতে পরপর তিনবার জামিন চেয়েও পাননি। তাই এবার তারা, বিশেষ করে মূল দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দুই স্বত্বাধিকারী নতুন ফন্দি এঁটেছেন।

তারা জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেছেন। আবেদনে তারা বলেছেন, তাদের জামিন না হওয়ায় প্রকল্পের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি তারা জেলে বন্দি থাকায় প্রকল্পের কাজ আটকে আছে। জামিন দিলে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেবেন তারা। এছাড়া দুই ঠিকাদারকে পরিশোধ করা বিলের টাকা ফিরিয়ে নেয়ায় এখন তারা বলছেন, যেহেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ তাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত নিয়ে গেছে, তাই এই শর্তেও তারা জামিন পেতে পারেন।

তবে দুদক বলছে, যাদের কারণে সরকারের এত বড় প্রকল্পের কাজ প্রশ্নবিদ্ধ হল তারাই এখন বলছেন, জামিন না দিলে প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হবে। এটা বড় ধরনের হটকারী বক্তব্য। এছাড়া তাদের দিয়েই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করা হবে- এই ধারণা তারা পেল কোথায়?

দুদকের প্রধান কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, আসামিরা জামিন পেতে নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করছে। তবে আমরা তাদের বিষয়ে সোচ্চার রয়েছি। আদালতে আমরা একটি প্রতিবেদন দাখিল করছি। শুনানি কার্যতালিকায় রয়েছে।

এদিকে হাইকোর্ট এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন চেয়েছেন দুদকের আইনজীবীর কাছে।
পাবনা গণপূর্ত দফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান খন্দকার স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদন দুদকের কাছে ইতিমধ্যে এসেছে। সেটি উচ্চ আদালতে উপস্থাপন করা হবে বলে জানান অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান। গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলম ছাড়া অন্য যে ১২ জনের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছিল তারা হলেন- পাবনা গণপূর্ত উপবিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী জাহিদুল কবির, মোস্তফা কামাল, শফিকুল ইসলাম, আহমেদ সাজ্জাদ খান, সুমন কুমার নন্দী, আবু সাঈদ, রওশন আলী ও তাহাজ্জুদ হোসেন, সহকারী প্রকৌশলী তারেক, আমিনুল ইসলাম, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী আসিফ হোসেন ও সাজিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শাহাদত হোসেন। তারা সবাই এখন জেলে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গণপূর্ত অধিদফতরের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাসুদুল আলমসহ ১৩ জনের অবৈধ সম্পদের গোপন অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এছাড়া দুদকের মামলার তদন্তও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তদন্ত করছেন দুদকের উপপরিচালক নাসির উদ্দিন। শিগগিরই তিনি আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেবেন বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে প্রকল্পের অনিয়মের ঘটনায় তৎকালীন গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের কোনো দায় আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া ১৩ আসামির বাইরে আর কতজন সম্পৃক্ত রয়েছেন, তদন্ত প্রতিবেদনে তাও তুলে ধরা হবে।

আসবাবপত্র ও ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী কেনাকাটার অনিয়মে ৩১ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর তাদের বিরুদ্ধে পৃথক চারটি মামলা করে দুদক। দুদকের উপপরিচালক নাসির উদ্দিন ও উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান মিরাজ বাদী হয়ে পাবনায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাগুলো করেছিলেন।

মামলার পরপরই ১৩ আসামিকে রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, তাদের জন্য কারাগারের বাইরে থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় খাবার পাঠানো হয়। এমনকি আসামি আসিফ হোসেন ও সাজেদ কাশিমপুর কারাগারে বেশ কয়েকটি সিলিংফ্যান ও ২টা এলইডি টিভি সেটও কিনেছেন বলে অভিযোগ। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে কাশিমপুর কারাগারের পার্ট-১ এর ডেপুটি জেলার সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

শুরুতে দুদকের কাছে আসা অভিযোগে বলা হয়, প্রকল্পের দুটি ভবনের জন্য কেনা বালিশের মধ্যে একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে বালিশের দাম ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা, সেই বালিশ ফ্ল্যাটে উঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা দেখানো হয়েছে।

এভাবে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, খাট, বিছানা, ওয়ারড্রোব, বৈদ্যুতিক চুলা, বৈদ্যুতিক কেটলি, রুম পরিষ্কারের মেশিন, ইলেকট্রিক আয়রন, মাইক্রোওয়েভ ইত্যাদি কেনাকাটা ও ভবনে তুলতে অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে। জানা গেছে, রূপপুর গ্রিন সিটির মালামাল ক্রয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ দুদকে জমা পড়ে।

দুদক অভিযোগটি আমলে নেয় এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংঘটিত দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত সময়ে প্রকল্পের মালামাল ক্রয়ে বাজারমূল্য থেকে বেশি দাম দেখানো হয়। অতিরিক্ত পরিবহন খরচ, তলাভিত্তিক উত্তোলন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি যোগ করে প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। কার্যাদেশ প্রদানের আগেই মালামাল গ্রহণ, সাজানো দরপত্র প্রকাশ ও কার্যাদেশ দেখিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধের নামে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

তবে মামলায় এই অঙ্ক খুব বড় না হলেও দুর্নীতিটি বড় বলে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, অতিরিক্ত পরিবহন খরচ, তলাভিত্তিক উত্তোলন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি যোগ করে প্রাক্কলন প্রস্তুত করে আসামিরা। কার্যাদেশ প্রদানের আগে মালামাল গ্রহণ, সাজানো

দরপত্র প্রকাশ ও কার্যাদেশ দেখিয়ে ঠিকাদারকে পরিশোধের নামে ৭ কোটি ৭৯ লাখ ৪২ হাজার ৪৩৮ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। প্রকল্পের ২ নম্বর ভবনের ৭৫টি আইটেম সংগ্রহে একই কায়দায় ৭ কোটি ৪৮ লাখ ১৬ হাজার ৬৮ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। প্রকল্পের তিন নম্বর ভবনের ৬৩টি আইটেম সংগ্রহে একই কায়দায় ৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮ হাজার ৭১৬ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয়।

এছাড়া প্রকল্পের চার নম্বর ভবনের ৯২টি আইটেম সংগ্রহে একই কায়দায় ৮ কোটি ১২ লাখ ৭৯ হাজার ৯৫০ টাকা আত্মসাৎ করার অপরাধ অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়। সব মিলিয়ে চারটি মামলায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে ৩১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ১৭২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। যদিও দুই ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয় ৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তারা সরকারের কিছু এইইটি ও ভ্যাট কেটে বাকি টাকা তুলে নেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ওই টাকা ফেরত নেয়া হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/287229