১৮ মার্চ ২০২০, বুধবার, ১২:০৪

আরিফের সঙ্গে ডিসি সুলতানার ফোনালাপ ফাঁস: চুপচাপ থাকার পরামর্শ

নতুন ডিসি যোগদান করেননি * মাগুরায় অন্যায়ভাবে এক ওষুধ ব্যবসায়ীকে ১ বছর জেল দেন আরডিসি নাজিম উদ্দিন

জেল থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগ্যানের সঙ্গে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের ফোনালাপের একটি অডিও ফাঁস হয়েছে। ফোনালাপে ডিসি সুলতানা সাংবাদিক আরিফকে মিডিয়া এড়িয়ে চুপচাপ থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, তোমার মামলা প্রত্যাহার করিয়ে দিব। একটু সময় দিবা।’

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই ডিসি সুলতানা এক ব্যক্তির মাধ্যমে আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ফোনে কথা বলেন। তাদের মধ্যকার ওই কথোপকথনের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

অডিওতে শোনা যায়, ডিসি সুলতানা পারভীন প্রথমে আরিফের কাছে তার অবস্থা জানতে চান। আরিফ তখন তাকে বেধড়ক মারধর কেন করা হয়েছে তা জানতে চান। একইসঙ্গে তার কাছ থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় স্বাক্ষর নেয়া চারটি কাগজ ফেরত চান। উত্তরে ডিসি সুলতানা পারভীন বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তোমাকে ফেরত দেব কথা বলে নিজে আমি তোমাকে ফেরত দেবো...যদি নিয়ে থাকে ওরা। কোন কাগজে সই নিয়েছে। তোমার মোবাইল কোর্টের ইয়াতে সই ছিল, বুঝছো।’

আরিফ এ সময় বলেন, ‘আমার চোখ বাঁধা অবস্থায় চারটা সই নিয়েছে।’ ডিসি বলেন, ‘মোবাইল কোর্টের আদেশে তোমার সই নিয়েছে। ওটা মোবাইল কোর্টের ইয়াতেই। আচ্ছা, যাই হোক এখন ঘটনা যেভাবে ঘটে গেছে, যা ঘটেছে তুমিও ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেইখো। আমি নিজেও আসলে অনুতপ্ত। তুমি একটু রেস্ট নাও। যাও। থাকো। নিরিবিলি একটু থাকো, ঠিক আছে।’

আরিফুল জানতে চান তিনি এনকাউন্টার দেয়ার মতো অপরাধ করেছেন কিনা। উত্তরে ডিসি সুলতানা বলেন, ‘এনকাউন্টারের মানসিকতা আসলে আমাদের ছিল না। ওইভাবে ছিল না।’ আরিফ ডিসিকে বলেন, আপনি আমাকে একদিন ডাকতে পারতেন, আমি কি আসতাম না? উত্তরে ডিসি বলেন, ‘না, সেটা আসতা। এখনও আসবা, সমস্যা নাই। এখন ধরো যে, কষ্ট তো তুমিও পাচ্ছো, কষ্ট আমিও...হয়ে গেছে যেটা, এটা এদিকে দেখতে হবে একটু পজিটিভলি। এটাই বলার জন্য...।’

ডিসি আরিফের কাছে কী ইচ্ছা জানতে চাইলে আরিফ এ সময় ডিসিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তারা কী উদ্দেশ্যে এই কাজটি করলেন এটা আমার জানা বাঞ্ছনীয় এবং তারা আমার চারটি কাগজে সই নিয়েছে, কেন নিয়েছে এটা আমার দেখতে হবে। আমার দুই নামেই সই নিয়েছে তারা এবং আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই চিন্তিত।’ এ সময় ডিসি বলেন, ‘তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটা চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে, ভালো থাকবা ইনশাআল্লাহ।’

মিডিয়ায় ডাকতে পারে জানালে ডিসি বলেন, ‘এখন কী করতে চাচ্ছ? আমি যেটা বলব যে এখন মিডিয়াকে অ্যাভয়েড করে থাকো। দেখা যাক আল্লাহ ভরসা। আমরাও তোমার পাশে আছি আর কী।’

আরিফ এ সময় আবার চোখবাঁধা অবস্থায় স্বাক্ষর করা কাগজের প্রসঙ্গ তুললে ডিসি বলেন, ‘ঠিক আছে আমি খোঁজ নিয়ে দেখি। এটা তো মোবাইল কোর্টের নির্দেশনাতেই ছিল। অন্য কিছুতে নেয়নি। আর তোমার বিষয়ে অত ইয়া তো আমাদের...যাই হোক...ঘটনাটা ঘটেছিল।’

মামলা প্রসঙ্গে ডিসি বলেন, ‘তোমার মামলা প্রত্যাহার করে দেবো, সমস্যা নাই। একটু সময় দিও। একটা দুইটা শুনানির সময় লাগবে। তোমার চাকরির ব্যাপারেও আমি দেখব। চাকরির ব্যাপারে কোনো টেনশন করো না।’

জানতে চাইলে আরিফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘কারাগার থেকে বের হওয়ার পর জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এক ব্যক্তির মাধ্যমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফোনে তার সঙ্গে কথা হয়। আমি তাকে কিছু প্রশ্ন করি। তিনি এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি আমাকে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে চুপচাপ থাকতে বলেন। আমি আসলে তখন আতঙ্কিত ছিলাম। আমি আমার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত ছিলাম।’

কথোপকথনের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সুলতানা পারভীনকে পাওয়া যায়নি। রোববার দুপুরে ‘জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করা হচ্ছে’?

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এই বক্তব্য দেয়ার পর থেকেই তিনি সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলছেন। সোমবার জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এবং জেলা প্রশাসনের তিন কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু কান্তি দাশ ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছে।

মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ও নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম এখনও কুড়িগ্রামে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, তার ডান হাতে ফাটল ধরা পড়েছে। এছাড়া সারা শরীরে ব্যথা রয়েছে। মানসিকভাবে আতংকে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

এদিকে ঘটনায় প্রত্যাহারকৃত জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের স্থলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগকৃত নতুন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম এখনও যোগদান করেননি। আগামী বৃহস্পতিবার তিনি যোগদান করতে পারেন বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।

মাগুরায় এসিল্যান্ড থাকায় আরডিসি নাজিম উদ্দিনের যত অপকর্ম : সাংবাদিক আরিফকে নির্যাতনের নেতৃত্বদানকারী আরডিসি নাজিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কুড়িগ্রামের আগে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় এসিল্যান্ড ছিলেন তিনি।

সে সময় ব্যক্তি আক্রোশে তিনি স্থানীয় ওষুধ ব্যবসায়ী আবু জাফর বাদশা ফকিরকে মোবাইল কোর্টে এক বছরের সাজা দেন। এ ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে তিনি স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন।

বাদশা ফকির জানান, নাজিম মহম্মদপুরে কর্মরত অবস্থায় সরকারি খাসজমি ইজারা বন্দোবস্ত দেয়ার উদ্যোগ নেন। যার কাছ থেকে যেমন খুশি অর্থ নিয়ে এসব বন্দোবস্ত দেন।

সরকারি জমির সঙ্গে আমার নিজের জমি রয়েছে। যেটি নিয়ে মামলা চলছে। বিরোধপূর্ণ ওই জমির ঝামেলা মিটিয়ে দেয়ার কথা বলে তিনি আমার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নেন। বিষয়টির সমাধান করে না দেয়ায় টাকা ফেরত চাইলে তিনি আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।

পরে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে ১ বছরের জেল এবং ২ লাখ টাকা কারাদণ্ড অনাদায়ে আরও ৩ মাসের জেল দেন। বাদশা ফকির আরও বলেন, আমি ২ মাস ৩ দিন জেল খাটার পর হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছি। এ অবিচারের জন্য আমি তার শাস্তি চাই।

মহম্মদপুর বাজারের রড সিমেন্ট ব্যবসায়ী মেসবাহুল ইসলাম বলেন, আমার চাচা আফসার উদ্দিন মাস্টারের জায়গা নাজিম উদ্দিন অন্য লোকের নামে ইজারা দেন। এ ঘটনায় প্রতিবাদ করায় তিনি আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে ২ মাস ব্যবসা বন্ধ করে দেন।

শুধু তাই নয়, এসিল্যান্ড হিসেবে কর্মরত অবস্থায় নাজিম মহম্মদপুর উপজেলায় এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন। সে সময় নহাটা বাজারের ব্যবসায়ীরা তার অপসারণ দাবি করে বিক্ষোভ করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, স্থানীয় কিছু মানুষ সরকারি জায়গা দখল করে রয়েছে। তাদের উচ্ছেদ করতে যাওয়ায় তারা আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেছে।

এদিকে সোমবার দুপুরে স্থানীয় সাধারণ মানুষ নাজিম উদ্দিনের বিচার চেয়ে মহম্মদপুর উপজেলা সদরে মানববন্ধন করেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/290202/