৮ মার্চ ২০২০, রবিবার, ১:২৪

বাড়ছে নির্যাতন

নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ধর্ষণ-গণধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এমন কোনো দিন নেই যে দিন নির্যাতিতা নারী চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছেন না। মানবাধিকার কর্মীসহ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটবেই।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে নারীর প্রতি সহিংসতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে বিপুলসংখ্যক নারী যৌতুক, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি এবং এসিড নিক্ষেপ ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদেরও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

অধিকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালে ধর্ষণ ব্যাপক আকার ধারণ করে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক যে মেয়েশিশুদের ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার ভিকটিমরা বিচার পান না। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাবানরা সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বা অন্যভাবে ম্যানেজ করে বিচারকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সালিস করে মিটমাট করে দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক সময় এসব ক্ষেত্রে থানা পুলিশ জড়িত থাকে। ২০১৯ সালে মোট ১০৮০ জন নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে ৩৩০ জন নারী, ৭৩৭ জন মেয়ে শিশু এবং ১৩ জনের বয়স জানা যায়নি। ওই ৩৩০ জন নারীর মধ্যে ১০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ১৫০ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং দু’জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। ৭৩৭ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে ৩২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ১৩৭ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং পাঁচজন মেয়ে শিশু আত্মহত্যা করেছেন। এ সময়কালে ১৪৯ জন নারী ও মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

এর বাইরে আরো অনেকে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। অধিকার তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০১৯ সালে মোট ১৮৯ জন নারী বখাটেদের হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪ জন অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন, ছয়জনকে হত্যা করা হয়েছে, ২১ জন আহত, ৩৪ জন লাঞ্ছিত, দুইজন অপহৃত এবং ১১২ জন নারী বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে সাতজন পুরুষ ও একজন নারী নিহত, ২১ জন পুরুষ ও আটজন নারী আহত এবং দুইজন নারী লাঞ্ছিত হয়েছেন।

এ চিত্র চলতি বছরেও বদলায়নি। চলতি বছরের গত দুই মাসে ২৩৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১২১টি এবং ফেব্রুয়ারিতে ১১৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। সংগঠনটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ওসিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়ে ২১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন, যা আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭০, আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১২০ জন।

মানবাধিকার আইনজীবী ও জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেছেন, ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের দিকনির্দেশনা চেয়ে রিট দায়ের করা হয়। ২০০৯ সালে এ ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি দিকনির্দেশনা প্রদান করে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের অভাবে সেই দিকনির্দেশনাগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। সালমা আলী বলেন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন অবিলম্বে প্রণয়ন করা জরুরি।

মানবাধিকার কর্মী মোস্তফা সোহেল বলেছেন, নারী নির্যাতনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। বিচারে বিলম্ব, দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়া, আইনি সঠিক সহায়তা না পাওয়া ইত্যাদি নানা কারণে বেড়েই চলছে নারী নির্যাতন। তিনি বলেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই নারী নির্যাতন বন্ধ হতে পারে।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/486394/