৫ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১২:০৭

বিভক্তি ও মেরুকরণে কল্যাণ নেই

মানুষ মানুষকে মারবে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে- এজন্য তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি, রাষ্ট্র গঠন করেনি। মানুষ তো নিজের প্রয়োজনে উন্নত জীবনের আকাক্সক্ষায় সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেছে। কিন্তু মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্রের আজ একি হাল হয়েছে? মানুষ মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এমন অভিযোগ নতুন নয়, তবে মাত্রাটা বোধ হয় বেড়েই চলেছে। সমস্যাটা শুধু ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের নয়, প্রাচ্য পাশ্চাত্য সর্বত্রই ওই সঙ্কট দৃশ্যমান। বিষয়টিকে আসলে সভ্যতার-সঙ্কট হিসাবেই বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণেষর দায়িত্ব তো সরকার রাজনীতিবিদ, বিদ্বজ্জন, ধর্মগুরু ও প্রাগ্রসর মানুষদের ওপর বর্তায়। গুরুত্বপূর্ণ এইসব মহল তাঁদের দায়িত্ব পালনে সফল হলে তো পৃথিবীর আজ এই হাল হতো না। তবে এ নিয়ে ব্লেমগেমের কোনো কোনো প্রয়োজন নেই। বরং এখন প্রয়োজন স্বদেশের সঙ্কট উপলব্ধি করে এবং ভ্রান্ত কর্মনীতি পরিহার করে সঠিক রোডম্যাপে সবার এগিয়ে চলা। সময়ের এই আহ্বানে কারা এগিয়ে আসেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত। দেশটির সাধারণ মানুষের সাথে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের রয়েছে ঊষ্ণ সম্পর্ক। কিন্তু সেই দেশটিতে যখন এক ধর্মের মানুষের ওপর অপর ধর্মের মানুষের নিষ্ঠুর আক্রমণ চলে, তখন সৃষ্টি হয় নানা প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নের সঠিক জবাব তেমন লক্ষ্য করা যায় না। ব্লেমগেম আর প্রপাগাণ্ডার মাত্রাটাই বেশি। এমন প্রবণতা আমরা দিল্লীতে সংঘটিত সাম্প্রতিক দাঙ্গায়ও লক্ষ্য করেছি। এ প্রসঙ্গে সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘দ্য ওয়ার’-এ বক্তব্য রেখেছেন সিদ্ধার্থ ভরদ্বারাজন। তিনি ‘দ্য ওয়ার’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও ‘দ্য হিন্দু’র সাবেক সম্পাদক। সিদ্ধার্থ ভরদ্বারাজন বলেছেন, নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের (সিএএ) পক্ষের বা বিপক্ষের বড় বড় সংবাদমাধ্যম দিল্লীর ঘটনা বর্ণনা করার সময় ‘বিক্ষোভকারী’ অথবা ‘দুই পক্ষ’ সংঘর্ষে জড়িয়েছে বলে যে তথ্য দিচ্ছে, তাতে কেউ বিভ্রান্ত হবেন না। ভগবানের দোহাই, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি ‘দুর্বৃত্তরা, ভারতের বদনাম করার জন্য চক্রান্ত করছে’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিশ^াস করবেন না। কারণ, এটি মোটেও সংঘাত নয়, এটি হামলা। এই হামলা যারা করেছে তারা কেউ অচেনা নয়। তিনি আরো বলেন, ৭০ দিন ধরে দিল্লী ও অন্যান্য জায়গায় সিএএ নিয়ে যাঁরা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন, তাঁরা কোথাও কোনো অশান্তি ঘটাননি। তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় পতাকা হাতে ধর্নায় বসেছেন। তাঁদের হাতে ছিল সংবিধানের কপি কিংবা ড. বি আর আম্বেদকর, মহাত্মা গান্ধী ও মাওলানা আজাদের ছবি। তাঁরা কোথাও পাথর ছোঁড়েননি। কারো বাড়িঘর জ¦ালাননি। কাউকে মারধর করেননি। ৭০ দিন ধরে তাঁরা অহিংস প্রতিবাদ করে যাওয়ার পরও আচমকা কেন দিল্লী সহিংসতায় ভরে গেল? কারা এই ঘটনা ঘটালো? কারা এমনটি হতে দিল? সিদ্ধার্থ ভরদ্বারাজন আরো বলেন, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র পুলিশের উপস্থিতিতে বিজেপি কর্মীদের মুসলমানদের ওপর সরাসরি হামলা চালানোর আহ্বান জানানোর পর থেকেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি প্রশ্ন করেন, হামলাকারীরা যদি শুধু সিএএ-এর সমর্থনে রাস্তায় নেমে থাকে, তাহলে তারা কেন ‘হিন্দুস্তানমে রেহনে হোগা তো জয় শ্রীরাম বোল না হোগা’ স্লোগান দিচ্ছিল? এটি স্পষ্ট যে হিন্দুত্ববাদীরা সিএএ সমাবেশের নামে নির্বিচারে মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়ে এমন একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছে। যাতে গোটা দিল্লীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ তৈরি হয়। আসল সত্য হলো, মুসলমানদের দিক থেকে কোনো ধরনের উস্কানি ছাড়াই উত্তর-পূর্ব দিল্লীতে মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। যেভাবে বাবরি মসজিদের মিনারে উঠে গৈরিক পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, অশোক নগরের বড় মসজিদে ঠিক একই কায়দায় হিন্দুত্ববাদীরা হামলা চালিয়েছে। একই কায়দায় মিনারে উঠে হনুমান পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিজেপির চরিত্রই হলো বিভক্তি ও মেরুকরণ করা। তাদের এই সাম্প্রদায়িক বিষ যদি গোটা ভারতকে শেষও করে দেয়, তাহলেও সে বিচ্ছুর মতো কামড় বসাবেই। মোদি ও অমিত শাহ হয়তো মনে করছেন, এই উন্মাদনা ভারতকে দুর্বল করলেও বিজেপিকে শক্তিশালী করবে। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, দেশকে দুর্বল করে কোনো দল শক্তিশালী হতে পারে কী? জনগণ তা মেনে নেবে কী? দলের চাইতে দেশ কী অনেক বড় নয়?

দিল্লীর দাঙ্গা শুধু ভারতের জন্য নয়, বর্তমান সভ্যতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বার্তা দিয়ে গেল। আসলে কোনো জনপদে যখন দাঙ্গা সংঘটিত হয়, তখন সেখানকার রাজনীতি, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সমাজনেতারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েন। কারণ সুস্থ সমাজে দাঙ্গা হতে পারে না। আর দিল্লীতে যখন দাঙ্গা শুরু হয়, তখন তো শহরটিতে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, বর্তমান সভ্যতার অন্যতম শাসক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প যদি মার্কিন নীতির আলোকে মৃদুভাবেও একটু কথা বলতেন দাঙ্গার বিপক্ষে, তাহলে মানবতার কল্যাণ হতো, অনেক মানুষ ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যেত; এতে উপকার হতো ভারতেরই। কিন্তু তিনি মানবতা কিংবা ভারত কারোই উপকার করতে সমর্থ হননি। তিনি আসলে আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিনীদের ভোট পাওয়ার আশায় মোদির পক্ষে চুপ ছিলেন। সার্থান্ধ এবং দুর্বল নীতির এমন নেতাদের দিয়ে এই পৃথিবী কিংবা সভ্যতার কোনো কল্যাণ হতে পারে না।

এতবড় ঘটনায় মানুষের, জাতির, সভ্যতার আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। আত্মসমালোচনা ভুল উপলব্ধি করতে এবং পরিশুদ্ধ হতে সাহায্য করে থাকে। এ কারণেই বর্তমান সভ্যতায় আত্মসমালোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে উঠেছে। আত্মসমালোচনা, উপলব্ধি ও সংশোধন-কর্মকে গুরুত্ব না দিয়ে নেতা-উপনেতা, বিদ্যান ও যাজকরা যদি নীরব থাকেন কিংবা আত্মস্বার্থে অন্যায় ও অনাচারকে সমর্থন করে যান, তাহলে আমাদের প্রিয় এই পৃথিবী আর কতদিন মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে? আশার কথা আত্মসমালোচনা করার মতো মানুষ, দিকনির্দেশনা দেয়ার মতো মানুষ এখনো পৃথিবীতে বর্তমান আছে। তাইতো বিতর্কিত ও ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব আইন ঘিরে দিল্লীর সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নোবেল জয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি শনিবার শান্তিনিকেতনে এক আলোচনা সভায় ভারতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। অমর্ত্য সেন প্রশ্ন উত্থাপন করেন, ধর্মনিরপেক্ষ দেশে মুসলিম হত্যা কেন? ভারতের গণতন্ত্র প্রসঙ্গে জন স্টুয়ার্ট মিলকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘ডেমোক্র্যাসি ইজ গবর্নমেন্ট বাইডিসকাশন’। এই আলোচনা যদি বন্ধ হয়, তাকে যদি রাজদ্রোহ বলে চাপা দেয়া হয়, তাহলে নিশ্চয়ই ডেমোক্র্যাসির অভাব আছে বলে মনে করার কারণ থাকবে।

বিতর্কিত ধর্মভিত্তিক নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে দিল্লীতে যে ভয়াবহ দাঙ্গা সংঘটিত হলো, তাতে ভারতের জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো এর আগেও নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে। জানা গেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজেরই নাগরিকত্বের কোনো কাগজপত্র নেই। জন্মসূত্রে তিনি ভারতের নাগরিক। গত পহেলা মার্চ কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় মুদ্রিত খবরে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৭ জানুয়ারি শুভঙ্কর সরকার নামে এক ব্যক্তি তথ্য অধিকার আইনের (আরটিআই) মাধ্যমে জানতে চান, মোদির নাগরিকত্বের কাগজপত্র রয়েছে কিনা। এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সচিব প্রবীন কুমার জানান, ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভের মধ্যে এই তথ্য বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বিশেষত আসামে যখন কথিত নগরিকপঞ্জিতে ঠাঁই না পাওয়ায় বহু মানুষকে বন্দীশিবিরে পাঠানো হয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এরপর নাগরিকত্বের নথিপত্র চাওয়া হলে আমজনতাও যদি জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের দাবি তোলে, তা কী গ্রাহ্য হবে? বিজেপির কাছে এর কোনো সদুত্তর আছে কী?

আসলে বিজেপি সরকার যদি সংবিধানের আলোকে ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকদের কল্যাণের কথা ভাবতো তাহলে ভারতের রাজনীতিতে অশনি সংকেত দেখা দিত না। দিল্লীর দাঙ্গাও সংঘটিত হতো না। বৈচিত্র্যের ঐক্য চেতনার বদলে শুধু হিন্দুত্ববাদী চেতনা দিয়ে এত ধর্ম ও বর্ণের দেশ প্রগতির পথে কীভাবে এগুবে? এই প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই প্রশ্নের সঙ্গত জবাব খুঁজে নিতে হবে মোদি সরকারকে!

http://dailysangram.info/post/408872