৫ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৯

বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের নেপথ্যে

দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েই চলেছে। প্রতি বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হচ্ছে গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৬৪ হাজার কোটি টাকা। মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। এর বাইরেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বাংলাদেশের টাকা পাচারের তথ্য উদ্‌ঘাটন হচ্ছে। এর মধ্যে সুইস ব্যাংক এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন

আইসিআইজের পানামা ও প্যারাডাইস পেপারেও বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা উদ্ঘাটন হয়েছে। টাকা পাচার বন্ধে দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাণিজ্যিক ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং সিআইডি কাজ করছে।

জিএফআই’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং)। এর মধ্যে সবচেয়ে দুর্নীতি হয় কলকারখানার যন্ত্রপাতি, খনিজ জ্বালানি বা চিকিৎসা পণ্যের আমদানি-রপ্তানিতে। এসব পণ্যে আমদানির ক্ষেত্রে বেশি দাম দেখানো হয়। আর রপ্তানির ক্ষেত্রে দাম কম দেখানো হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, প্রতিষ্ঠানটি অর্থ পাচার সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। তথ্য গোপনের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের কাছে জানতে চেয়েছি তারা কোথায় কোথায় তথ্য পাঠায়। বিশেষ করে পরিসংখ্যান বিভাগ জাতি সংঘের কাছে কোনো তথ্য পাঠায় কিনা। এসব বিষয় খোঁজ-খবর নিচ্ছি। বিভাগটি জানালে তারপর বলতে পারবো বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, জিএফআই প্রতি বছর এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে হালনাগাদ তথ্য না থাকায় ২০১৫ সালের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। তবে তারা ২০১৭ সালের তথ্যের ভিত্তিতে অন্যান্য দেশের রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথ্য দিলেও বাংলাদেশের ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোনো তথ্য দেয়নি। বাকি ৭ বছরের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে অর্থ পাচারের হিসাব দেয়া হয়েছে। প্রতিবছরের গড় অর্থ পাচারের হিসাবে ওই ১৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৩৩ তম।

সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুসারে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক মিত্রদের সঙ্গে বাংলাদেশের মূল্য ঘোষণার গরমিলের হার দেশের মোট বাণিজ্যের ১৮ শতাংশ। এর আর্থিক মূল্য আনুমানিক ৬৪ হাজার কোটি টাকা। গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরমিল দেখা গেছে ২০১৫ সালে। সে বছর দেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে পাচার হয়ে গেছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। বাণিজ্যে মূল্য ঘোষণায় গরমিলটি হিসাব করা হয় দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক তথ্য ব্যবহার করে। যেমন, বাংলাদেশ যদি বলে তারা ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২ কোটি ডলারের প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র দেড় কোটি ডলার মূল্যের প্লাস্টিক পণ্য আমদানির দাবি করে তাহলে বাণিজ্যে গড়মিলের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ লাখ ডলার। এমন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জিএফআই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশ থেকে বিভিন্ন পথে টাকা পাচারের মধ্যে অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে, পণ্য আমদানির এলসি খুলে বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে দেয়ার পরও পণ্য দেশে না আনা। আমদানি মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ বিদেশে পাঠিয়ে, এলসিতে উল্লিখিত পরিমাণের চেয়ে কম পণ্য দেশে আনা। এভাবে বেশি দামের পণ্যের এলসি খুলে কম দামের পণ্য দেশে এনে টাকা পাচার করা হচ্ছে। এর বাইরে অনলাইন ব্যাংকিংয়ের আওতায়ও টাকা পাচার হচ্ছে। এছাড়া হুন্ডি, স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকার পাচার হচ্ছে। এর বাইরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে না এনে বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এসব প্রক্রিয়ায় এখন দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তেও এ ঘটনা ধরা পড়েছে। বিশেষ শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল আমদানির নামে টাকা পাচার হচ্ছে বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, আমদানির জন্য শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। কিন্তু কনটেইনারের ভেতরে পাওয়া গেছে বালি ও ইটের গুঁড়া। ফলে ওই অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দেশি ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রাহক টাকা বিদেশের ব্যাংকে পাঠায়। বিদেশি ব্যাংক থেকে ওইসব অর্থ স্থানান্তর করা হয় রপ্তানিকারকের ব্যাংক হিসাবে। রপ্তানিকারক ওই অর্থ আমদানিকারকের হিসাবে স্থানান্তর করে দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় দেশি ব্যাংক, বিদেশি ব্যাংক, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক মিলে টাকা পাচার করছে। আর এ কাজে সহায়তা করছে আমদানি তদারককারী সংস্থা কাস্টমস, বন্দর কর্তৃপক্ষ। এসব প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা পণ্য দেশে না আনলেও কাগজপত্রে দেখিয়ে দিচ্ছে পণ্য দেশে এসেছে। একই প্রক্রিয়ায় কম পণ্য দেশে আনার মাধ্যমে বা কম দামি পণ্য দেশে আনার মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে।

বিদেশের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে গ্রাহক যে পরিমাণ পণ্য রফতানি করে তার পুরোটা দেশে আনে না। বাকি অর্থ বিদেশি ব্যাংক আমদানিকারকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে দেয়। আমদানিকারক তা রপ্তানিকারকের বিদেশের কোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে টাকা পাচারে সহায়তা করছে দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। কেননা রপ্তানির মূল্য ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে দেশে আনার কথা। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে দেশে না আনলেই তা পাচার বলে ধরে নিতে হবে। ব্যাংকগুলো এসব এ বিষয়গুলো তদারকি করে না বলে এ প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার হচ্ছে।

এছাড়া নগদ আকারে বা চোরাচালান বা হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে মোটা অংকের অর্থ পাচার হচ্ছে। বিশেষ বন্দর বা সীমান্ত এলাকা দিয়ে এগুলো পাচার হচ্ছে। ডলারের কার্ব মার্কেটের মাধ্যমে আবার বিদেশে চলে যাচ্ছে। হুন্ডিতে যে রেমিটেন্স আসছে সেটি পাচার হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকা পাচার করার পথগুলো বন্ধ করতে হলে আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এছাড়া টাকা পাচার বন্ধ হবে না। তিনি বলেন, টাকাকে অলস রাখা যাবে না। বিনিয়োগমুখী করতে হবে। তাহলে পাচার কমে যাবে।

জিএফআই তাদের প্রতিবেদনে এমন গরমিলকে সরাসরি অর্থ পাচার বলেনি। মূলত গরমিলের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে। জিএফআই বলছে, ৩৫টি উন্নত দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ দেশের ব্যবসায়ীরা তুলনামূলক কম মিথ্যা ঘোষণা দেন। এই হার ওই সব দেশের সঙ্গে মোট বাণিজ্যের ১৪ শতাংশের কিছুটা বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছরে গড়ে ৩২৯ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে ওই সব উন্নত দেশে চলে গেছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, যে কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। অনেকেই এ দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করেন না। তার মতে, যন্ত্রপাতির মূল্য বেশি দেখিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করা হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=215966