৫ মার্চ ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:৫৮

বিদ্যুৎ উন্নয়ন ফান্ডে অলস সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকা

বিদ্যুৎ উন্নয়ন ফান্ডে অলস পড়ে আছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দেশে গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয়ও অনেক বেড়ে গেছে। এতে জনগণের ওপর বাড়ছে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চাপ। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে মানুষ নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ গত ২৭শে ফেব্রুয়ারি বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন-এই তিন পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়েছে।

যা বর্তমানে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৭৭ পয়সা। এ বৃদ্ধি ১লা মার্চ থেকে কার্যকর করেছে বিইআরসি।

২০১১ সালের ফেব্রয়ারিতে প্রথম বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। সে সময় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর উৎপাদন ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাইকারি(বাল্ক) পর্যায়ে বিদ্যুতের বিদ্যমান গড় মূল্যের ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ অর্থ বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন ফান্ড সৃষ্টির জন্য ধার্য করা হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি ও ভোক্তা পর্যায়ে এর বিক্রয়মূল্য সহনীয় রাখার জন্য তহবিলটি সৃষ্টি করা হয়েছিল। এ অর্থে উচ্চ প্রযুক্তির জ্বালানিনির্ভর দক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার শর্ত দিয়েছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। নয় বছরে এর সামান্যই ব্যবহার হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অলস পড়ে আছে তহবিলে জমাকৃত ৯ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।

বিইআরসি’র বার্ষিক প্রতিবেদন (২০১৮-২০১৯)-এর তথ্য অনুয়ায়ী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন ফান্ডে ২০১০-১১ অর্থ বছরে জমা পড়েছে ১৪৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, ২০১১-১২তে জমা পড়েছে ৫১২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭১৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ তে জমা পড়েছে ৯৫৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক হাজার ৩৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২শ’ ৭০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার ৫০৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জমা পড়েছে ১২শ’ ৯৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন ফান্ডে জমা পড়েছে এক হাজার ৬২১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর থেকে বিবিয়ানা গ্যাস বেইজড কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টে ২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই কেন্দ্র থেকে ৩৮৪ মোগওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদানের ক্ষমতা রয়েছে। এর ৭৫ শতাংশ কাজ শেষে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিইআরসি’র সদস্য (বিদ্যুৎ) মোহাম্মদ বজলুর রহমান। তিনি জানান, এই ফান্ড থেকে কনভার্শন অব সিলেট (১৫০ মেগাওয়াট জিটুজি, ২২৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি) বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এতে বরাদ্দ রয়েছে ৭৬০ কোটি টাকা। এই কেন্দ্রের ৮৫ শতাংশ কাজ শেষে হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। নির্মাণাধীন রয়েছে শাহজীবাজার ১০০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতে বরাদ্দ আছে ৮৮৮ কোটি টাকা। ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে এক হাজার ১৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর ৯১ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর একটি ইউনিট ইতিমধ্যেই চালু হয়েছে বলে বিইআরসি’র এই সদস্য উল্লেখ করেন। এছাড়া চট্টগ্রামের রাউজানে ৫৫০-৬০০ মেগাওয়াটের এইচ ক্লাস কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে বরাদ্দ ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

ফান্ড গঠনের আদেশে বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন ফান্ড হবে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে জাতীয় বিনিয়োগ। বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নতির লক্ষ্যে ও ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য সহনীয় রাখার জন্য এ অর্থ ব্যবহার করা হবে। এ ফান্ডে সঞ্চিত অর্থ দ্বারা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) প্রথম বছরে ৩৬৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা পাবে, যা দিয়ে উচ্চ প্রযুক্তির জ্বালানি দক্ষ ন্যূনতম ৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। পরবর্তী বছরে ওই অর্থ দিয়ে বিদ্যুতের বাল্ক মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভর্তুকির পরিমাণকে হ্রাস করবে। বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ ব্যবহারে একটি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা দেয়া হয় পিডিবিকে। পরের বছর এ নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়। এতে চারটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়। এগুলো হলো পুরোনো কেন্দ্র বিএমআরই করা, গ্যাসভিত্তিক পুরোনো প্ল্যান্টের স্থলে নতুন প্ল্যান্ট স্থাপন, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও লিস্ট কস্ট-ভিত্তিতে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্যাসপ্রাপ্তি সাপেক্ষে নতুন দক্ষ জেনারেশন প্ল্যান্ট স্থাপন করা। বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ ব্যবহারের ২৫টি প্রকল্পও চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে নয়টি পুরোনো কেন্দ্র ওভারহলিং, দুটি রি-পাওয়ারিং, ছয়টি নতুন কেন্দ্র নির্মাণ, ছয়টি কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর ও দুটি কেন্দ্র সমপ্রসারণ প্রকল্প ছিল। এ বিষযে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমত উল্লাহ অনেক হিসাব কষে বলেন, গড়ে বিদ্যুতের মূল্য ৪ টাকা ২৬ পয়সার উপরে হওয়ার কথা নয়। দুর্নীতির জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে।

বিদেশে বাড়ি বানানোর জন্যই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন ফান্ডের টাকা দিয়ে সরকার কি করে তা জানার অধিকার এদেশের মানুষের রয়েছে।

এই বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুৎ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন ফান্ডের জন্য বেশকিছু প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে বিবিয়ানা দক্ষিণ প্রকল্পে কিছু অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। রাউজানে কাজ হচ্ছে। জমা রাখা টাকা দিয়ে উন্নয়নের কাজ হচ্ছে।

বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ শুনানির পর বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। তবে কখনও কখনও পাইকারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। ২০১০ সালের ১লা মার্চ গ্রাহক পর্যায় ৬ দশমিক ৭ ভাগ বেড়েছিল। সেবার পাইকারিতে বাড়েনি। ২০১১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি গ্রাহক পর্যায় ৫ ভাগ এবং পাইকারিতে ১১ ভাগ বেড়েছিল। ২০১১ সালের ১লা আগস্ট গ্রাহক পর্যায়ে বাড়েনি। তবে পাইকারিতে ৬ দশমিক ৬৬ ভাগ বাড়ানো হয়। ২০১১ সালের ১লা ডিসেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ১৩ দশমিক ২৫ ভাগ এবং পাইকারিতে ১৬ দশমিক ৭৯ ভাগ বাড়ানো হয়। ২০১২ সালের ১লা সেপ্টেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ১৫ ভাগ এবং পাইকারিতে ১৭ ভাগ, ২০১৫ সালের ১লা আগস্ট গ্রাহক পর্যায়ে ২ দশমিক ৯৩ ভাগ বাড়ানো হয়। সেবার পাইকারিতে বাড়েনি। ২০১৭ সালের ১লা ডিসেম্বর গ্রাহক পর্যায়ে ৫ দশমিক ৩ ভাগ বাড়ানো হয়। সেই সময়ও পাইকারিতে বাড়েনি।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=215968